Saturday 1 July 2017

আফজল আলি




কবিতায় শব্দের জাড্য ধর্ম ও নিউটনের গতিসূত্রের প্রয়োগ










নিউটনের গতিসূত্র অনুযায়ী আমরা জানি কোনো বস্তুকে বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ না করলে স্থিতিশীল বস্তু চিরকাল স্থিতিশীল এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল একই বেগে থাকবে।এখন বাইরে থেকে বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ একটা ফ্যাক্টর।শব্দ নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিউটনের এই সূত্রটাই কবিতার ক্ষেত্রে খুব প্রযোজ্য বলে মনে হয়েছে।শব্দ-বাতাস উড়ে বেড়ায় অথবা অভিধানে ধরা থাকে।কোনো শব্দ যখন শুধু শব্দ হিসেবে থাকে তার কার্যকারিতা আমরা সেভাবে বুঝতে পারিনা।কিন্তু সেই শব্দ যখন কোনো কিছুর দ্বারা আকড়ে আবদ্ধ হয় ,তখন সেই শব্দ শক্তিশালী হতে আরম্ভ করে।সেই শব্দের মধ্যে বস্তুগুন কার্যকরী হয় । গীতা কোরান বাইবেল ত্রিপিটক জিন্দাবেস্তা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ , বিভিন্ন মন্ত্র ,কবিতা,এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে গদ্য ,এসবের মধ্যে আমরা সংঘবদ্ধ শব্দের রুপ প্রবল থেকে প্রবলতর দেখতে পাই।পূজাপাঠ বা নামাজে ঠাকুর দেবতা বা আল্লাকে সন্তুষ্ট বা স্মরণ করার জন্য যা উচ্চারিত হয় পদ্ধতিগত সমাহারের মাধ্যমে তা তো নিশ্চয় সংঘবদ্ধ শব্দ ,শব্দমালা ।বিভিন্ন ভাবে গ্রন্থিত ।আমরা জানি যে বিশ্বের প্রথম উচ্চারিত শব্দ "ওং" ধ্বনি।মন্ত্র এবং ধর্মগ্রন্থে উচ্চারিত শব্দের শক্তি বা ক্ষমতা দেখে আমাদের পূর্বপুরুষরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে শব্দই "ব্রহ্ম"।এখন শব্দের উপর ব্রহ্মাত্ব আরোপ এমনি এমনি আসে না । সব মানুষের মধ্যে ঈশ্বর থাকেন কিন্তু সব মানুষই ঈশ্বরের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ দেখাতে পারেন না বা কার্যকরী হয় না।তা মহাপুরুষই পেরেছেন ।Prophet, রসুলরাই পেরেছেন।শব্দের মধ্যে যে নিহিত শক্তি থাকে তা কার্যকরী করতে গেলে বাইরে থেকে শক্তি দ্বারা প্রভাবিত করতে হয়।আর তখনই আমরা দেখতে পাবো শব্দের বস্তুগুন ।শব্দ হলো বস্তু ভাব বা কার্যকরণের প্রতিনিধিত্ব রুপ। কাজেই বস্তুর দ্বারা কার্যকরণের অনুভব ধরা থাকে শব্দরন্ধে।
                   নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের apllication কবিতার ক্ষেত্রে বলতে গিয়ে যে প্রসঙ্গগুলো উঠে আসছে তা তো এড়াতে পারিনা।কবিতার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই থাকলেও আমরা জানি কবিতা হলো একপ্রকার reflection যেখানে শব্দ সমাহৃত হয়।বিভিন্ন tuning এ বিভিন্ন frequency তে। Reflection বলতে যা বুঝি তা হলো কিছু ভাব বা কথন কবিতার দ্বারা reflect হতে থাকে।আমরা বাইরে থেকে tuning বা frequency দেখতে পাই না,বুঝতে পারি না;কিন্তু একজন নির্দিষ্ট দীক্ষিত পাঠক বা কবি ঠিক ধরতে পারেন সেই reflectionএর তীব্রতা ।ঠিক এই জায়গাটিতে বাইরে থেকে শক্তি প্রযোগ হয় এবং শব্দের মধ্যে বস্তুগুন আরোপিত হয়।বাতাসে শব্দ ওড়াউড়ি করে।কবি তার কল্পনা এবং মানসিক শক্তি দিয়ে সেই শব্দকে নামিয়ে আনেন এবং নির্দিষ্ট শব্দ সজ্জা তৈরি করে কবিতার রুপ দেন।সেই শক্তি প্রয়োগ করে শব্দকে কতটা সচল বা কার্যকরী বা বেগবান বা শক্তিশালী করতে পারব সেটা নির্ভর করছে কবিকৃত শব্দের ওপর তার মধ্যস্থ শক্তি কত কার্যকর হচ্ছে।এই কার্যকারীতার উপরেই কবিতার থেকে অপর একটি কবিতা ফারাক হতে আরম্ভ করে; এখানে শব্দের বেগবান হওয়াটা বাইরে থেকে বুঝতে পারি না,কিন্তু তৈরি হওয়া reflection বা কম্পনের তীব্রতা থেকে কবিতার গভীরতা ও মান নির্ণয় করা যায়।এই জায়গাটিতেই কবিতার ক্ষেত্রে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের প্রয়োগ দেখা যায়।এবং শব্দের জাড্যধর্ম কার্যকর হয়।
                    এই বাহ্যিক শক্তি (শব্দকে বস্তু ধরে) আবার অনেকগুলো শক্তির সমাহারে নিবিষ্ট।যেমন কবির জন্মগত প্রতিভা কল্পনাশক্তি, আহোরিত অভিজ্ঞতা , ভাবদর্শন ,মেধা,পরিবেশ এবং কবিত্ব শক্তি ।এই বাহ্যিক শক্তির দ্বারা কবিকৃত কবিতার তীব্রতা ভাবের প্রকাশ এবং কবিতার হয়ে ওঠার ডিগ্রি/ ঘাত নির্ভর করে।
                     একজন নতুন লিখতে আসা যে কেউ কবিতাকে কিভাবে দাঁড় করাবেন তা নির্ভর করে তার ভিতরের তৈরি হওয়া শক্তি দিয়ে শব্দকে কতটা তীব্রতায় সচল করতে পারবেন বা কম্পন সৃষ্টি করতে পারবেন ।এই তীব্রতা বা কম্পন তৈরি হয় শব্দ প্রয়োগ ও ব্যবহারের মাধ্যমে।কিভাবে প্রয়োগ করেছেন , কিভাবে ব্যবহার করেছেন । অর্থাৎ বাহ্যিক শক্তি দ্বারা কবি কতটা বল প্রয়োগ করতে পারলেন শব্দের উপর- এখানেই তার লেখনী শক্তির সার্থকতা ।-এর উপরেই কবিতা হয়ে ওঠে কাঁচা দুর্বল ও rediation হীন।শক্তিশালী কবি শব্দটা এভাবেই এসেছে কারন তিনি শব্দের উপর তীব্রশক্তি প্রয়োগ করতে পারেন,তাই শক্তিশালী কবির কবিতা শক্তিশালী হয় ।শক্তিশালী হওয়ার ক্ষেত্রে ভাবার প্রকাশ,জটিলতা বা সরলতা নির্ভরশীল নয়। যা নির্ভরশীল তা হলো প্রতীয়মানতা। একটি শক্তিশালী কবিতা তার ওপর আরোপিত শক্তির গুনে তীব্র হয়ে ওঠে, তৈরি করে communicating power এবং তা আলাদা হতে আরম্ভ করে এবং সেই তীব্রতা এসে পৌঁছায় পাঠকের কাছে, পাঠককে ধাক্কা দেয় , আন্দোলিত করে এবং গোদা বাংলায় আমরা বলি পাঠক তৈরি হয়।একটি কবিতা সময় উত্তীর্ণ হবে কিনা তা কবিতার মধ্যে নিহিত শক্তির উপর নির্ভরশীল।
                           অভিজ্ঞতা শব্দটি কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযোজ্য।দর্শনে অভিজ্ঞতা বলতে শুধু বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনার কথা বলা নেই,বরং বলা আছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভবের মধ্য দিয়ে এক বয়ে চলা।চোখ দিয়ে দেখা কানে শোনা ,পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ক্রিয়াশীলতা মন ও মননের উপর ।
          কাজেই কবি শক্তির মধ্যে আমি যে  অভিজ্ঞতার কথা বলেছি তা শুধু কবির পড়াশুনার উপর নির্ভরশীল নয়।
দার্শনিক হাইডেগার বলেছেন- ' কবি এবং সৃজনশীল মানুষেরাই পারেন তাদের মধ্যে নিহিত শক্তি দ্বারা ভাষার পরিবর্তন ঘটাতে এবং সমাজে সেই প্রভাব ক্রিয়াশীল হয়।' আমরা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে দেখতে পাই আমাদের হাজার বছরের কাব্যভাষা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে শক্তিশালী কবিদের দ্বারা ।এবং সমাজ ও পাঠকও আন্দোলিত হয়েছে সেইভাবে।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের হাত ধরে তা পরিচিত হয়েছে আবার কারো কারো হাতে খুব তীব্রভাবে যেমন মাইকেল মধুসূদন , রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ । এর বাইরে অনেক কবি আছেন যাদের দ্বারা বাংলা কাব্য ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে বা আন্দোলিত হয়েছে বিভিন্ন যুগ বা সময়ের প্রেক্ষিতে ।তা আমি আলোচনা করছি না কারণ আমরা তো সবাই জানি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস।
বরং পরের সংখ্যায় দেখাই কবিতার ক্ষেত্রে বাহ্যিক শক্তি কিভাবে কার্যকরী হয়।


                                                                *** ক্রমশ ***

7 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো দাদা।বহুদিন আগে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছের উপর বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ নিয়ে একটা পরীক্ষা হয়েছিল।মনে পড়ে গেলো

    ReplyDelete
  2. লেখাটার যথেষ্ট বাস্তব ভিত্তি আছে। গভীর নিরীক্ষা আছে। অনন্য ভাবনা আছে। এভাবে কবিতা নিয়ে ভাবনার একটা নতুন দিশা পেলাম।

    ReplyDelete
  3. Pandit kobi ar bybaharik kobir parthakya bOjha gelo.

    ReplyDelete
  4. আফজালদা আপনার লেখা পড়ে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটল।আমি আপনার সাথে একমত ।কবিতা যে বিজ্ঞানের সাথে মিলেমিশে আছে তা হাতে প্রমাণ করা যায়।লেখাটি সম্পূর্ণ পড়তে চাই ।পরে •••••

    ReplyDelete
  5. পুরোটা পড়লাম। আপনার গভীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখতে পেলাম।

    ReplyDelete
  6. পড়ে ভাল লাগল। সমৃদ্ধ হলাম

    ReplyDelete
  7. এক অনন্য চিন্তনের প্রতিফলন। বিজ্ঞান আর সাহিত্যের সম্পর্কায়ন শক্তির ভিত্তিতে - আসাধারন!!!

    ReplyDelete