Friday 1 September 2017

সম্পাদকীয়

নির্জনে সোনার হরিণ...





" কথাওয়ালা এসেছে চাতুর্য নিয়ে
আমাকে দেখাচ্ছে দিকবদলের প্রলোভন
ঘন মেঘের ভেতর ঢুকে পড়েছে মনুষ্যত্ব
নদীর দীর্ঘ রেখা জানে কান্নার ইতিহাস
পোস্টার খুঁজছে শ্রমজীবী মানুষের হাত
আমি খুঁজছি অনাবিষ্কৃত ভূখন্ড পবিত্র "



                 (কবিতা: শূন্যতার লাথি-৪ ,তনুময় সরকার)


◻◻

যুগের হাত ধরে বাংলা কবিতা অনেক জাতের কবিকে প্রত্যক্ষ করেছে..। এই মুহূর্তে আমি যেটুকু উপলব্ধি করতে পারি তার ব্যাপারটা যদি খুলেই বলি তো তাহলে এই কবির জাতকে দুটো ভাগে ভাগ করছি ।

              (১) যান্ত্রিক কবি ,
              (২) সাধক কবি  ।

প্রথমেই বলি রাখি , এই দুটোর সাথে কোনোভাবেই রাজনীতি কিংবা ধৰ্মকে টানবেন না..। এই দুটো বিষয়কে আলাদা ভাবে দূরে সরিয়ে রেখেই অন্তহীন চলছে..। আসলে চলতে চেষ্টা করছে..। এই দুই ধরণের কবির ভাগটি নিতান্তই আমার নিজস্ব উপলব্ধি । আমি জানিনা এটা কার কথা , কেউ বলেছে কিনা । সে বিষয়ে আমি যাচ্ছি না , যেতেও চাইনা । আমি ওপেন একটা স্পেস রাখছি শুধু...
                 প্রলোভন । বিশ্বায়ন চারিদিকে । প্রতিটা কবিতা লিখিয়ে মানুষই কিছু না কিছু নতুন করার আশায় নিজেকে উজাড় করার কারিগর গড়ে তুলতে চাইছে । কেউ পারছে কেউ পারছে না । যারা পারছে , তাদের কেউ সঠিক কেউ বা হয়তো আগামীতে সঠিক প্রমাণিত হলেও হতে পারে । আমাদের কাজ আমাদের দায়িত্ব এই দুয়ের ডেডিক্যাশনকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া । যে বিশেষ কারণে দুই প্রকার কবির জাত টানলাম সেটা একটু খুলে বলি..। এখানে যান্ত্রিক কবি বলতে কী বলতে চাইছি না সেটা বলে নিই ।  যান্ত্রিক কবি মানে এটা তাকে বলছি না যিনি মেশিনের মতো লিখেই চলেছেন । তাকে বোঝাচ্ছি যিনি নিজের একটা কবিতা লেখার জন্য অন্য কোনো তথাকথিত বড়ো কবির ওপর নির্ভরশীল । যিনি স্বজ্ঞানে না , লিখে চলছেন নিজের গোঁড়ামি নিয়ে । যিনি উত্তরণের কথা না ভেবে, চান নিজেকে একটা মেশিনের মতো ,যিনি চান লেখা লেখাই । উত্তরণ , সময়ের উপযোগী , নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা , লেখার জন্য পরিশ্রম করা যার কাছে ঠিকঠাক গ্রহণযোগ্য না । উল্লেখযোগ্য একটা কথা বলি , অন্তহীন এমন কবিকে প্রশ্রয় দিতে চায়না । এমন আরো অনেক গুণাবলী এই বিশেষ জাতের কবির রয়েছে । যারা প্রলোভন দেখিয়ে রোজ রোজ আগামীর বীজকে নিজের স্বার্থে, প্রকাশ্য ঝংকারের ছন্দে মেতে উঠতে শেখায় তাদেরও প্রশ্রয় দেয়না ।  কবি হয়ে ওঠার পথে অন্য কবিকে পাঠকমহলে অপদস্থ করার পক্ষপাতিত্ব করার জন্যও প্রশ্রয় দেয়না ।
                    কবি একজন সাধক । কবি একজন আবিষ্কারক । আমি নিজে মন থেকে বিশ্বাস করি । কবিতা লেখা হয় নির্জনে । একাকিত্বে । তার জন্য আক্রমন ,অন্যকে নিঃশেষিত করার সঙ্গতি যারা দেয় ওই মুহূর্তে তাদের অনেকগুলো সত্ত্বার জন্ম দেয়। আমি বিশ্বাস করি কবি কবিই । কবিতা লেখার মুহূর্তে কবির একটাই সত্ত্বা । সে কবি । কারো সমালোচনা করতে পারি , অবশ্যই করতে পারি কিন্তু প্রত্যেকের একটা ডেডিক্যাশন থাকে সেটাকে সম্মান জানিয়ে । আমি ঠিক জানিনা ওভাবে কবিতা হয় কিনা ! কিংবা হতে পারে আমি পুরোপুরি ভুলভাল বকে চলেছি । আমি ছোট একজন সাহিত্য কর্মী । যার চর্চাটা কয়েকবছরের , কয়েক জায়গায় সীমিত । তবে যেটুকু অধ্যায়ন করে জেনেছি , তাতে কোনোদিন কোথাও পড়িনি জীবনানন্দ দাশ বুদ্ধদেব বসু এদের মতো কবিরা কারো ব্যক্তিত্বে আঘাত করেছে (রবীন্দ্রনাথের কথা ছেড়েই দিলাম)। আমি এদেরকেই মানি কবি , কবি...। কবি সমালোচনা করবে কবিতা দিয়ে । উত্তর দেবে কবিতা দিয়ে । কবি তার ভেতরের আলোড়ন বাইরে আনবে কাব্যশক্তির উৎসমুখ নিয়ে । আমি বিশ্বাস করি না এর বাইরে আর কিছু দরকার বলে । আমারা  কবিতার কারিগর , আমরা কবিতার শিল্পী । শিল্পে সাধনা লাগে তাবেদারী লাগেনা । তাই এটাই বলা ,আমরা কি পারি না নিজেদের সুস্থ করে সুষ্ঠ একটা কবিতার পরিবেশ তৈরি করতে যেখানে পাঠকরা কবি বলতে খারাপ চরিত্রের মানুষ বলবে না , কবিরা একে অপরকে সম্মান না করতে পারলেও আক্রমণ করবে না ? পারি না ? সত্যিই পারি না...



       এবার আসি অন্য দিগন্তে । অন্তহীন আগের বছরের জুলাই মাসে প্রথম অনলাইন সংস্করণ বের হয় । উল্লেখ্য বলে রাখি , অন্তহীন প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছে মুদ্রণ সংস্করণে..। মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিল মে মাস নাগাদ..। এই দীর্ঘ সময়ে পেয়েছি অনবদ্য কিছু কবিদের ,পেয়েছি এমন কিছু কবিতা যাদের জন্য বিশেষ কোনো বিশেষণের দরকার পড়েনা । একবছর পেরিয়ে আজ ভাবতে বসলে পেছনটা একটা নস্টালজিক গন্ধ ভেসে আসে..। অন্তহীনের মুদ্রণ প্রাকলগ্ন থেকে যারা রয়েছে তাদের কিছু কিছু নাম এখনো একইভাবে সাথে আছেন যেমন শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য সৌমিত্র রায়..। অন্তহীন প্রকাশকাল থেকেই যে কবি সর্বশেষ সংখ্যা পর্যন্ত কোনোরকম আভিজাত্য না দেখিয়েই মাটির মানুষের মতো সম্পাদকের সাথে থেকেছেন তাদের মধ্যে কিছু কবির নাম না করলেই নয়..। এমন কিছু কবি যেমন - তৈমুর খান দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ।
                অন্তহীন অনলাইনে যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে সেই সময় থেকে যারা সাথে আছেন তাদের কিছু নাম না বললেই নয় , সৌম্যদীপ রায় , দীপ রায় , বিশ্বজিৎ দাস, মহাদেব নাথ । এক্ষেত্রে বলে রাখি , দীপদা প্রথম থেকেই সাথে থেকেছে । একটা অনলাইন পত্রিকা কেমন ভাবে গড়ে উঠতে পারে কেমনভাবে লেখা নির্বাচিত করা যায় সে বিষয়ে সতর্ক করেছে । আমি অনেক কৃতজ্ঞ এমন অনেকের কাছে । অন্তহীনের পথ চলায় সাথে পেয়েছি কুমারেশ তেওয়ারী ,সুবীর সরকার ,রাহুল গাঙ্গুলী, রুমা ঢ্যাং ,পার্বতী রায় , দীপ্তি চক্রবর্তী, সুকান্ত ঘোষাল, রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়,শুভদীপ সেনশর্মা । এনারা প্রথম থেকে অন্তহীন পত্রিকার পরিবার। পরে পরে আরো অনেককে পেয়েছি সবার নাম হয়তো এই সীমিত পরিসরে আনা সম্ভব হলো না..। তাদের সবাইকে আমার অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা । পেয়েছি অয়নকে । সহ-সম্পাদকের আসনে বসানো কোনো ভুল যে নয় সেটা প্রমাণিত । ভালো মতোই বুঝতে পারছেন সচেতন ভাবে দুজনের নাম না বলে এগিয়ে এসেছি  , বললাম এতগুলো কথা । দুজন । মুরারি সিংহ , আফজল আলি । অন্তহীনে যারা যুক্ত আছেন সবাই জানেন আর বেশি কিছু বলতে হবে না..। কোনো বেশি বলছি না।মুরারিদাকে মেদিনীপুরে কয়েকবার সামনাসামনি পেয়েছি । বুঝেছি ,শিখেছি অনেক । আফজলদা তো দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই সরাসরি একটা অন্যমাত্রায় অন্তহীনের সাথে যুক্ত আছেন..। সাহস জুগিয়েছেন । এই দুজনের কাছ থেকে যা পেয়েছে অন্তহীন কিংবা অন্তহীনের সম্পাদক তা অনস্বীকার্য । সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ এভাবে একবছর আমাকে সহ্য করে লেখা দিয়ে সাহায্য করার জন্য..। অন্তহীন কবিদের আগে নয়..। কবিদের সাথে , কবিদের অন্তরে থাকতে পছন্দ করে..।



কিছু কথা বলি , প্রথম কয়েকটা সংখ্যায় হয়তো ঠিকঠাকভাবে মনোনয়নের কাজ খোলামনে করতে পারিনি । কারণ সেভাবে লেখা জমা হয়নি । মাঝে কয়েকমাস বন্ধ রাখি । তারপর নতুন করে শুরু করি । এখন সত্যি বলছি , বহু বহু লেখা দিয়েছেন আপনারা । দিয়ে চলেছেন আপনারা । আগামীতেও দেবেন এমন আশা রাখি । কিন্তু কোনোভাবেই অন্তহীন চায়না ,লেখা নিম্নমানের অথচ পত্রিকার পাতায় সুযোগ পেয়ে যাবে..। আমাদের সমস্ত লেখা প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই..। আমরা চাই নিরেট একটা কবিতার পরিবেশ তৈরি করতে । প্রায় ৫০এর কাছাকাছি আমন্ত্রিত কবিদের কাছ থেকে লেখা চেয়েছি আগ্রহ জানিয়েছিলাম । কিন্তু লেখা পৌঁছতে পৌঁছতে সেই সংখ্যাটা ৪০এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে...। যারা দিয়েছেন তাদের সমন্ধে আর কীই বা বলতে পারি..। অনেক অনেক শুভকামনা রাখে অন্তহীন । যারা দিলেন না তাদের অনেকে হয়তো অন্তহীনকে সেভাবে আপন করতে পারেননি..। কিংবা আমারই ব্যর্থতা সেভাবে আপনাদের মনের মধ্যে অন্তহীনকে জায়গা করে দিতে পারিনি..। সে বিষয়ে অত্যন্ত দুঃখিত আমি..। আগামীতেও সবাই সাথে থাকবেন..। এভাবে একবছর যেন শত বছর পর্যন্ত আপনাদের লেখা প্রকাশের অঙ্গীকার হয়ে উঠতে পারে আপনাদের অন্তহীন ।  কৃত্যজ্ঞতা স্বীকার করি সব অলংকারিককে..। এই সংখ্যায় পত্রিকার সমস্ত লেখায় থাকছে রুমা ঢ্যাং এর অলংকরণ..। এতক্ষণ আমার বকবকানি পড়ছেন আমি কৃতজ্ঞ..। সবাইকে অন্তরের গভীর থেকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা । সবাই ভালো থাকবেন..।
                 

সহ-সম্পাদকীয়

অয়নের চিঠি...




দেখতে দেখতে একটা বছরের দোর গোড়ায় এসে আমরা উপস্থিত। পরিবর্তন দেখতে অভ্যস্ত মানুষ কিন্তু এখনও কবিতার হাত ছাড়েনি, আর ছাড়বেই বা কী করে? কবিতা কী মায়া নয়! এই যে আমি লিখতে বসলাম প্রিয় পত্রিকা অন্তহীনের কথা, কী লিখবো ভাবতে ভাবতে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ছে অনেকগুলো মুখ। যাদের কবিতা প্রতিটা সংখ্যায় সমৃদ্ধ করেছে এই পত্রিকাকে। এতদিনে আমরা দেখেছি নানা পরিবর্তন ধর্মে ধর্মে হানাহানি, ভণ্ড সাধুর ভণ্ডামিকে দেশ যখন জর্জরিত তখনও কিন্তু আমরা কবিতার মধ্যে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করেছি। আর এইভাবেই আমরা হয়ত কবিতার হাত ধরে মুক্তির পথ খুঁজবো। এর মধ্যে আবিষ্কার হয়েছে "জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট"।খুলে গেছে কবিতার নতুন দিক। আর এই আবিষ্কারক হলেন স্বয়ং আমার কবিতার গুরু আফজল আলি। ওনার হাত ধরে কবিতাযাপনের পর আমার প্রথম প্রকাশিত কবিতা এই অন্তহীনেই। বলতে গেলে অন্তহীনের কাছে আমি ঋণি। আজ দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। তবে কৃতিত্ব শুধু আমাদের নয়, আপনার আমার সকলের। পাঠক এবং কবিদের ছাড়ায় একটু একটু করে বেড়ে চলেছে অন্তহীনের যাত্রা। জানি না কতদিন কলম ধরতে পারবো এই পত্রিকার জন্য, তবে স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী? আমিও স্বপ্ন দেখি নতুন নতুন মুখ উঠে আসবে এই পত্রিকার হাত ধরে। শরতের মেঘ কেটে আগমনী বার্তা নিয়ে আসে যে সূর্য তেমনই আসুন আমরা সকলে মিলে এগিয়ে চলি কবিতার জন্য। বর্ষপূর্তি সংখ্যায় কেকের মতো কিছু মিষ্টি এবং সুন্দর কবিতা নিয়ে হাজির হবো। আপনারা সকলেই ভালো থাকুন আর সৃজনে থাকুন আর এটাও ভুলবেন না আপনার জীবনও কিন্তু কবিতার মতো সুন্দর!

তৈমুর খান



       
     
আমি মরতে চেয়েছিলাম 
     

কেউ রজকিনী নয়, অথচ আমি মরতে চেয়েছিলাম
বউয়ের কাছে এবং প্রেমিকার কাছেও

কিন্তু অসফল হয়েছিলাম বলে
অর্ধমৃত বয়ে বেড়াচ্ছি নিজেকে

কত কত সোনার ধান বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে
তাদের প্রেমিকার হাতে চক্চক্ করছে সোনার বালা
তাদের বউয়ের গলায় দুলছে হিরের নেকলেস
বাগান ভরে যাচ্ছে ঢেউ খেলানো ফণায়
উৎসবের ঢোল বেজে উঠছে আর দুলছে অমৃতভাষিণী ফণাগুলি

দূরে আমি কয়েক হাত অন্ধকারের গভীরে
শুঁটকি মাছ আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করছি রাত্রির খাবার
দু একটা শূকর এসে শুঁকছে দুয়ার
নূপুর বাজার মরশুম খাঁ খাঁ করছে পৃথিবীতে
কবরের অন্ধকারের মতো রাত্রি অদৃশ্য পোকারা কাটছে

আমার শুঁটকি মাছ পোড়া গন্ধ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরের বাতাস


             
নিছক একাকী বাঁশি 
             

অসম্ভবের গাড়ি চড়ে চলে যাচ্ছি
একান্ত কৌতুক ইচ্ছা
সঙ্গে আছে অবাস্তব আমাদের মহিমারঞ্জন
অযোগ্যতা যদিও প্রচার করছে সবাই
নিজেরা দেবতা হয়ে ঘরকে করেছে দেবালয়

আমি শুধু রাস্তার কুকুর
পিছন পিছন গেছি প্রেমিকার

সূর্য আকাশ ঘিরে আছে
রাষ্ট্র ও পুলিশ আছে আর সমাজ নক্ষত্র সব
জাত এবং ধর্মের বিষাদ এসে আমাকে ছুঁড়েছে ঢিল
কখনো কখনো বিষতির

অসম্ভব রক্তক্ষরণের পর চলে যাচ্ছি
অশ্রুভেজা শুকনো হাতে মেঘের ইশারায়
আজ ছায়া নড়ে উঠছে
ঝরে যাচ্ছে আমার প্রণয় আর শূন্য বাতাসের মদ
নিছক একাকী বাঁশি আমাকে বাজায়




উদিত শর্মা


 পোড়া রুটি



প্রতিদিনের নষ্ট শিরোনামে যে অচেনা আধূলি,
চলার বাঁকে বাঁকে কিছু দেনা ফেলে রাখে।

সবকটা বোতাম খুলে দিলেও ঘামে ভেজা সার্ট
শরীর ছাড়ে না কিছুতেই।
জীবন আসলে ----
ত্রুটিপূর্ণ মানুষের মিলিত সহাবস্থান।

পোড়া রুটির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েও দেখেছি
অনভিজ্ঞতার কম্পাসে প্রেম বৃত্তস্থ নয়।

আপাতত ট্রাম্পেটে ভাটিয়ালি শুনে দেখি যদি
কোনো চন্দ্রবাঁকা মধুমাস নতুন পোষাক আনে।



 ঘুড়ি



আমি দেওয়াল ফুড়ে সুতো ছেড়ে চলেছি
ঘুড়ি বানিয়েছি আকাশ কেটে।
ভাষা দিয়ে চেতনা আঁকা হলেও
সব ফুল কথা বলে না --
কিছু শুকিয়ে যায়, কিছু পোকায় কাটে।
মাছের উল্কি বুকে, ঘুড়ি উড়ে চলে সারারাত
মশারির কান্নাকে উপেক্ষা করে --
বিলি কেটে যায় হিজিবিজি
বাতাসের গভীরে।

উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়



কেলিকমল


যে যেখানে পারে দাঁড়িয়ে থাক
আমি গুছিয়ে নোব
মানুষেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে
এই সুযোগ
তোর পাশ দিয়ে চলে যাব টেরই পাবিনা
অবশ্য তোর স্টাইল
চিলকার ডলফিনের মতো
মানুষ কি শুধু
ডলফিনের জন্য চিলকা যায় ?

আমার বোহেমিয়ান কবিতার বই কাটার
শেষ উইকে আমার কেরদানির কথা
জানানোর প্রয়োজন নেই
                 
আমার কেলিকমল তোর হাতে
গুঁজে দিয়েই দে ছুট.....


 ছক্কা


সকালে পরীক্ষার পড়ার জন্য
তোর লুডো খেলা হয়নি
ছাঁচতলায় তোর মায়ের
ষোলো টুকরো রাগ কুড়িয়েছিলাম
ছক্কাটা পড়েছিল জুঁই-এর নীচে
কুড়োতে গিয়ে বিষ পিঁপড়ের কামড়
                                       খেয়েছি

আমার দেশলাই বাক্সে জোনাকিদের
হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য
তোকে কোন নেতা উস্কেছিল ?
রেগে মেগে ছক্কাটা লুকিয়ে দিতেই
বিকেলেও তোর লুডো খেলা হলনা
                   
এখন মাঝরাতে পড়ার টেবিলে
ছক্কাটা থেকে আলো আর আগুন
ব্যাটাচ্ছেলে যেন সূর্যের টুকরো
একাই খেলতে গিয়ে আমার
                       আঙুল পুড়ে ছাই
                 
শেষ রাতে এক দান হবে নাকি ?
আমি তো ঠুঁটো জগন্নাথ
তুই জিতবিই......

ভজন দত্ত



শুক,তোমাকে

                      

১.

শুক, তোমার জন্য  
এক নৌকো কবিতা  নদীর বুকে 
ভাসাবো ভেবে নিজেই কবে পাখি 
হয়ে গেলাম,সেকথা তোমাকে
বলা হলো না কোনোদিন। 

এপৃথিবীর সকল অসুখ থেকে
তুমি থাকো দূরের কোনো গ্রহে । 
সেখানে  দুটি আগ্নেয়গিরি 
জেগে উঠলে রোপিত হোক 
সবুজ ঈশ্বরীয় পতাকা।
বীজ ভেঙে, মাটি ফুৃঁড়ে,
আকাশে ডালপালা মেলে দিক,
তোমার গোপন আদুরী  স্বপ্ন।

সেখানে পাখিরা বসুক, শিস দিক
পাক না ভরসার আশ্রয় 

অলৌকিক মায়াবী আলোয় 
মৌমাছিরা চাকের রানিকে ভুলে
 নিজস্ব পছন্দে প্রিয় ফুলের 
পরাগরেনু মেখে মধুতে থাক।

মনখারাপে তোমাকে ভাবি,
হিংসার এক গভীর অসুখ।

 মুক্তির তমসা নদীতে ডুব,
ডুব  ডুব স্নান সেরে 
আর ওঠা হয় না কোনোদিন । 
দুঃস্বপ্নের রাত্রি সকাল হয় না। 

দখিনা বাতাসে ভাসে অস্পষ্ট  যমদন্ড। 
মনে হয়, শালা শুয়োরের,কুত্তার জন্ম ! 
ভাগাড় থেকে দূরে পড়ে আছে শবদেহ,  
কোনো শকুন আসে না দূরন্ত উল্লাসে...


২.

শুক, 
নববৃষ্টিধারায় যে কচি কচি ধানের চারা পুতেছিলাম তোমার দেওয়া বিষন্নতার মাঠে
ওরা সব মুড়ো হয়ে পড়ে আছে আল্ট্রাসোনোগ্রাফের কালো কালো দাগে...

৩.
স্থির নদী ধরে ঝাঁকাই

নিস্তরঙ্গ স্থির জলে 
কালো পাকা তাল ছুঁড়ে 
তোমাকে চঞ্চল করার চেষ্টা করি
পারি না কিছুই

একলা ঘরে যে টিকটিকিটি  
একদিন জাগাবার চেষ্টায় ছিল 
সেও আজ কেমন আরশোলা মুখে 
 শোকেসে স্থির হয়ে আছে

 তমসাময় সে রাতে
 দুগ্ধবতী ভোরের হাতছানি চিনে
 তোমাকে খুৃঁজি মোহর চাদর চিরে ফেঁড়ে...

রুমা ঢ্যাং



এপিডেমিক


মেঘের চিবুকে আস্ফালন দেখা দিলে
           আঙুর ক্ষেত হয়ে যায় একটা টাব
রোদের দাহ্যকথা ঢুলুঢুলু
রাস্তা মুছে বানরজাম্পের ছয়লাপ

চোখ মণিময়
মণিহারে জলের দাগ

সাগরের অনুবাদ করতে গিয়ে যা দেখলাম
   একটা ছোট নদীও কিভাবে যেন উপচিয়ে গেল
তাকে মাপতে কয়েক গ্যালনও কম পড়ে যায়
            যদিও বৃষ্টি ইস নট ওভার টিল নাও

ঘোড়াদের নিয়ে আমি যতই রাবারে টান দিই না কেন
     বর্ষার ফ্রেম ভাদর টেবিলে
আর ভিজে শহর জলের গভীরে মাথা পাতবেই

প্রতি ডিগ্রীতে বেড়ে যাচ্ছে একদাগ যন্ত্রণা
ডুগডুগি রাত জাগিয়ে রাখছে ওদের
                                  সব হারানোর অসাম সংশয় নিয়ে
যেখানে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টাঙাচ্ছি
     কারণ পৃথিবী একটা প্যারাডক্সের নাম
       যাকে কল্পনা কি করে বলি
 উইন্ডো অস্তিত্বের শোষণ এখানে এপিডেমিক




কুসুমরমণী প্রসঙ্গে


নেভানো বিকেলজাত মনের সামনে
            যে জলবৃক্ষ দাঁড়ায়
তার ঠোঁটের কোনে নিয়মিত একটা ঘন্টা বেজে চলেছে
বার্তা খুঁটছে বৃষ্টি
                 তার পায়ে সকালের ঢেউ

কুসুমরমণী আমড়া চিবোচ্ছে,
                   আলতাকাটা পায়ে পা রেখে
  কিন্তু তাকে প্রশ্ন করি নি
সূর্য আঁকা জটিল নাকি
                       চাঁদের শরীরের কুয়াশাঘুম

আর একবার তাথৈ মাস ঘিরে পতাকা জড়ো হলে বুঝতে সুবিধে হয়
  মধ্যদুপুরে যে রোদ বেপরোয়া
       তার কোন জালকাটা টান নেই
তাই,  নিজের মধ্যে গজিয়ে ওঠা শামুকের অস্তিত্বে
             ক্রমশ ইচ্ছার মুখ ঢেকে যাচ্ছে

দেখলাম লোকটা সার্কাসপার্টিতে নাম লেখালো
  আর মেয়েটা
                পাহাড়ের পাদদেশে রেখে দেয় কালোঝুল
সেখান থেকে জলপ্রপাত গড়িয়ে যায়
      যদিও পাখির গানে সেকথা বলা ছিল না                      

নবকুমার পোদ্দার

জীবন




একটা ঘর আলোর সঙ্গম
আমার পাশে পাশে থাকে

আয়না বলে দেয়
জীবনের শেষতম আসবাব


একটা আচ্ছন্ন প্রান্তর
ফুলের প্রিয়

          এসবের পাশে 

                     অভিমান...








নিরীহ অধ্যায়




অক্ষরের মতো সুন্দর এই দেহ
এই দেহ পরমহংসের চরাচর
ভাসিয়ে দিলাম রঙে,ধ্বনিতে
শব্দ,পয়ার আদি সুন্দরে

সমস্ত নীরবতা।সমস্ত স্বীকার
বিশ্বাস । ক্রমশ দাবানল।

লক্ষাধিক আগ্রহে ঘিরে রেখেছ যে দেহ!
আকাশের জোছনার মতো যার পরিধি;
তাকে বাঁধতে এই অনাবিল অত্যাচার :

ক্ষমা করো প্রভু-

পাখির ঘরে আমার মনস্কামনা সাজিয়ে দিও।

সুকান্ত ঘোষাল




নাছোড়বান্দা
যেগুলো সচল ছিল
ঠোঁটে ফুটো করে কেউ
        সামনে ঝুলিয়ে রাখেনি
ঘটনার বনে শাখা ভেঙেছো
          চমকপ্রদ
আমার রক্তের জেল্লা যা কখনো
গোঁজে আটকানো গোরু
চিবুক তুলে একাকী ওড়ায় ফিঙে
 
         এবং
সেই নাছোড়বান্দা
           বৃষ্টির নীচে প্লাস্টিকে
যতটা টিকিয়ে ছিল মাথা

রঙ্ রুটের বিহঙ্গ
কাঁদানে গ্যাসে আক্রান্ত আমার
শিক্ষাগত যোগ্যতায়
                    লেখা থাকে
রঙ্ রুটের বিহঙ্গ আর টিউব লাইটের
                    ডুয়েল
গুপ্তপ্রেস ঝুড়িতে সাজানো ফুটপাথ মুক্তি
নিজস্ব আবেদনে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে
                    যাতে অন্তত সাড়া মেলে
গাছের গোড়ালিতে চূর্ণ হচ্ছে বিকেল
                    কোন অস্ত্র
               আমার নামে হল না

আফজল আলি

প্রিয় তোলপাড়
               


ঘুম চুরি করে ঘুমিয়ে পড়ার পর দেখি পিছনটা ফাঁকা 
সমাজব্যবস্থা কি একইরকম আছে , প্রিয় তোলপাড়

আমার অভিবাদন গ্রহণ করো
আমাকে পাওয়ার অফ এটর্নি দিও না
ঘুমরাজ্যের দেশে কত কী আনন্দ আছে
দেখে নিই এখন

মোমবাতিগুলো , হ্যাঁ হ্যাঁ মোমবাতিগুলো জ্বেলে দিচ্ছো কেন
ঘুমের হাসিগুলো বড়ো বিরক্তকর 

আমি কান্নার কথা ভাবছিলাম কাল খুব খুব
আর ভাবছিলাম কামনা একটি রঙিন প্রজাপতি 
যেন উড়ে গেলেই ধ্বংসের উপর নির্মাণ হবে সুখ

            হৃদয় আচ্ছন্ন 
যন্ত্রণার বালিহাঁস অনেক উপরে উঠেছে
এসো বিবৃতি করি যা কিছু সঞ্চয় 
হ্যাঁ ছিল সেই প্রবল , যাকে তুমি ঝড় বলছ বেপরোয়া
কী ভাবব এখন
               


স্বরবর্ণগুলো মুখস্থ  করো না
বানান বিষয়ে তোমরা খুবই দুর্বল
ছন্দরসিকের গায়ে পিরিত ছিটিয়ে
চলো একটু বোহেমিয়ান হয়ে ঘুরি

নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে , অল্প বর্ষণেই বন্যা 
খুব সাধারণ থাকার চেয়ে আমার বুকের ব্যামো
ওহ , কী কেলেঙ্কারিই না ছিল
সিঁদ কেটে বৃন্দবনে ঢোকার আগে পাশওয়ার্ড ভুলেছিলাম
সারারাত  কাঁদার পরে আসলে যা বুঝলাম 
পৃথিবী ঠিক গোল নয় , দুদিকে  চাপা

আমার মামাও সে কথা বলত
তখন বুঝতাম না কমলালেবুর  গন্ধে কারো বাণিজ্য বাড়ে
কিংবা ফসফরাস জ্বললে জোনাকির অভিমান শুধু গাছের পাতায় থাকে না

তাহলে এখন কী নিয়ে ভাবব 
এবার পুজোর জামাপ্যান্ট ? ইদের কেনাকাটা  ? 
এই জন্মের পাপ চালান করে দেব গঙ্গায়?

আরে ছাড়ো ইয়ার , আমাদের অনুধাবনগুলো খুব মস্করা করতে চায়
কী করবে বৃথা  বিছানার চাদর পাল্টে এখন

দীপ রায়

দুরন্ত জানলা


হ্যালো লিটিল ফাইটার
কেমন ছিল তোমার আজকের সারাদিন
কোথায় ছোড়ে গেছে দেখাও
ঠোঁটের কোণে যে লেগে তাজা মাইক্রোক্রমের লাল

তোমার কব্জি এখন এগোচ্ছে ধীরেধীরে
মুঠোয় ধরা হট হুইলসের চাকা
আর ওই ট্রাজেক্টরীর ভিতরেই
 মেঝেতে একদল ভ্রূক্ষেপহীন পিঁপড়ের মিছিল
তোমার কব্জি এখন এগোচ্ছে প্যারালেলি...

এই যে দুরন্তপনা ছেড়ে আপাতত স্থির বসেছো
আমার কথা তুমি চুপ করে শুনছো
আমি টের পাচ্ছি একটি ভিন্ন এরিনা,
কিছু রঙিন পর্দা আর একটি উজ্জ্বল সূর্য
যারা কিনা তোমার এই পাশ কাটিয়ে যাওয়াকে
নীরবে পূর্ন সমর্থন করছে...
ক্রিমেটোরিয়াম 


সাদা এপিটাফ নিরন্তর রোদ মাখে
বলা ভালো রোদ একরকম
নিজেস্ব নিয়মেই প্রবেশপথ চিনে ফেলে...যত আস্তেই পা ফেল না কেনো
শুকনো পাতাদের মর্মর জানানি দেয়
যেমন পাশ কাটিয়ে চলে গেলে নিরীহ সাইকেল
আড়চোখে তাকায় মৌনমিছিল, বেলের ব্দে..

মুরারি সিংহ



বিন্যাস



আজ আবার প্রিয় চাঁপাগছটিকে নিয়ে
লিখি সাদা রং

 সান্দ্র-শরীরের প্রবাহে গাঁথা অবাক সুরালোক
          কিছু স্নান ছড়িয়ে আছে এলোমেলো
কিছু চোরাবালি চক্রান্ত ও মুখোসের পুজো

 এই যে সাজানো-গোছানো সংসারে রোজ রোজ
খেলার পুতুলেরা নড়েচড়ে অর্থহীন
        সেইসব ডুবও তুলির টানে মুছে যায়

 ফোয়ারা উপোস করে আছে
কুমড়োফুলে দ্রবীভূত বালিকা-বালক

 বাদলমেঘের মুদ্রাদোষ ও মমির রাজত্বে
আজ কিছু নীরব বিন্যাস
আবার ভাসিয়ে দিলাম
বহু দূরের নদীটিতে





ক্লাসিক


আর একটি রাত্রি অতিক্রান্ত হল
মাকড়াশার জাল ফিরে এল
নক্ষত্রদের ক্লাস থেকে
গায়ে নিয়ে শিশিরের জল

তুমুল গন্ধ নিয়ে ফিরে এল শিউলিরা
সকালের রোদ ও হাওয়ায় লেখা হল
        কিছু আত্মীয়তার রিহার্সেল

 কোনো এক ডুবজল থেকে দু-পঙক্তি টগবগ
এটুকু রাস্তা পার হতে
        মাথায় কি আকাশ ভেঙে পড়বে

বড়ো জোর পিছু নিতে পারে
কিছু নিবিড়তা কিছু ঘনিষ্ঠতা
           এবং সামান্য অভিমান

 তাদের ফুচকা-জলে স্নান করিয়ে
তুমি না হয় চলে এসো
কোনো ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের কাছে

সেখান থেকে তোমাকেও তো এবার
যেতে হবে
তোমার অতিপ্রিয় রোদচশমার ক্লাসে 

বিশ্বজিৎ দাস

হাইলাইটার পেন-১

হাইলাইটার পেন থেকে হৃদ্যতার আলো নিয়ে
ভাসিয়ে দিয়েছি সৌর-অভিসার
নেভানো গলায় চুপকথা রেখে তুমি হয়ে উঠেছ
পুষ্পবতী
বাসে ট্রামে আমজনতার ফ্যানেলে তোমাকে রতিসুখ
ভেবে ভেবে ফুটপাত করছে ময়লা! বয়সের চক্ষুরোগ
অসম্ভব বিলিয়ে নাটকীয় মহড়ায় ক্ষুর টেনে সরিয়ে
দিচ্ছে; জরুরি ওভারকোট...

নিলামে উঠে গেলেও তুমি মেয়ে
                                          নারী
                             পড়শি সুন্দরী
তোমার দেখভাল করে রাষ্ট্র! হাত বাড়িয়ে দেয় জিএসটি
দিল্লী, মধ্যপ্রদেশ দূরের কার্নিশ থেকে উদ্ধার হলে
যখন; বড় প্রেম ছুড়ে দিলে আইনের গালে!
ও তোমার কালো-সাদা বৈঠক গেল ভেস্তে...

ভূগর্ভস্হ জলেও নিজেকে চিনলে না
কত ঠাণ্ডায় মা হলে এমন ভাবে যে
বুঝলে না; বলাৎকার কাকে বলে?
পাথরের চেয়েও সঙ্গী হলো নিপুণ ভবিষ্যৎ!
কৃষকেরা খাজনা নেবে বলে, এখনো দাঁড়িয়েছে পথে
এ পথের সীমিত লালায় কিনেছ লাকি কুপন! তুমিতো
সব শেষ হয়ে এসে বলবে একদিন অমৃত মানেই গরল

জীবনের
প্রতিপালিত সিস্টেমে গিলোটিন
আয় আয় বলে ডাকতে থাকে; স্বপ্নযাত্রা
ঝাপসা হলে বুকে ব্যথা নিয়ে নোলক পরে
অবশেষে ডিসকানেক্ট! খুব বেশি সহজ হাসি
দিয়ে চলে যাও মর্গের বাসনার অবুঝ ঘরে...

স্মৃতি-মন্থন জেনে
আমৃত্যু খুলির কাছে কেঁদে কেঁদে জুড়িয়েছ
সকল জ্বালা| ন্যাশনাল হাইওয়ে নিয়ে আমিও
সমাপ্ত করি; মহিলা কম্পার্টমেন্টের আদি পালা
লিখেছি আমি| বাল্মীকি নই, কবিগুরু নই, নই একালের
কোনো বিরাট মাপের আগ্নেয়-লাভা! আমার হাতে আছে
অনিন্দ্য রায়ের হারপুন; তাকে সোহাগে সোহাগে করি
ধারালো...
জমকালো
রক্তমাখা
ব্লাউজ দেখে
গেঁথে দিই নিজস্ব প্রাইম অস্ত্র; গন্তব্যের জরায়ুতে
প্রতিটি পুরুষ এবার বলো, ব্যাধি কার তবে?...


হাইলাইটার পেন-২

হাসির মধ্যে যে সিংহ ছিল; তার গায়ে ঝিলিক দিয়ে
শিকার করেছ অঙ্গীকার! ওহ্, পোড়ামাটির ওপরে
মিথের বাড়াবাড়ি চিৎকার; অসহ্য লাগে! লাগে তো...
বেকার ছেলেটির এরচেয়ে বেশি কি পাওয়ার ছিল?

কলেজ পড়তে পড়তে এভাবেই এভারগ্রীণ স্বপ্নে
লাল হয়ে গেল কত যুবকের ফ্রেমওয়ার্ক
চোখ থেকে কত ঈর্ষা বেরিয়ে মজে গেছে সরলতা!
খেয়াল করোনি; কঙ্কালের ভিতরে আত্মমুগ্ধ-হত্যা
বেছে নিয়ে, এখনো সকালের রাস্তায় বাতাসের ভুলে
বসে থাকে একা, নিরালায়...

সম্পর্কের স্বীকৃতি বুঝে অনেকেই তোমাকে আলো করে
বুঝেছে; সামান্য কিছু তাপ থাকা সত্ত্বেও শীতল হয়েছে
শরীর| কথা আর ছবিতে জটিলতা বেড়েছে ক্রমশ...
হাত ধরে বাসনের কাছে আবাসন বড়ই ঝনঝনিয়ে
শব্দ করে, গা থেকে খুলে পড়ে; যাবতীয় দ্বায়িত্ব...
যে লোকটি কাল রাতেও ভেবেছিল, একটা বসন্ত পেলে
তোমাকে খুলে খুলে পরিয়ে দেবে ভালোবাসা, সে তো
এখন শুনছে; মৃতদের কনসার্ট!

নির্ভরযোগ্য সিট থেকে তুমি নিয়েছ নিউরন
গাণিতিক শিক্ষা তোমার শিরার ব্যালকনিতে
এখানে দাঁড়িয়ে নষ্ট করেছ; আলুচাষী থেকে
আইল্যান্ডের সর্বোচ্চ পুরুষকে...সকলেই জানে
সুযোগ একবার আসে আর তুমি কাজে লাগাও!

বন্দনা করে প্রকাশ্যে তোমাকে লিখে ফেলে ঘুম
ঘুমের আড়ালে বেঁচে থাকা; হর্ণ বাজিয়ে চলে যাওয়া
এসবই মধুর লাগে! অফিসের জরুরি ফাইল এক সময়
মিথ্যা হয়ে যায়, তোমার চোখের থেকে কুড়িয়ে নেয়
শেষ ঘুম! এবার বলো নারী; কে ক্ষতের সৃষ্টিকারী?

দেবযানী বসু

ভুখা জমি
ইচ্ছেডানার খাম আর ইচ্ছেঝরানো ঘাম ট্রাপিজ খেলার শূন্যতা মাপে. পাকদন্ডী মেপে মেপে উঠছে ফেসবুক. এলাকায় সগৌরবে বেঁচে তিনটি আমগাছ. ব্যক্তিগত হাওয়া. জল. টাকার কালনেমি বিচারে. আবহাওয়ায় লাগা বন্ধ্যা. ক্রস এন্ড নাট খেলছে চতুর্থ গাছটির সম্ভাবনা. 



কেজোমি

বালিশে কথা পোরার বিকেল.দুশো ছয় সংখ্যক হাড়ের প্রাচীন শব্দলিপি খুঁজে মরি রোজ.কুহকের হকদারিও ছাড়ি না. তোমাকে তাক করতে পারি তুক তো সম্ভবই না. রহস্য রহ হে চিরসখা. বহু বাস্তব আঁশহীন মাছ হবে কি করে. আমি আঁশ পরাই নিজেকে সাঁঝ উঠোনে এলে.

কুমারেশ তেওয়ারী



  এ সবই আলোর ক্যারামতি


তবুও একদিন এই পথ মেপে মেপে পৌঁছে যাওয়া
অনাবিলের কাছে। থকথকে প্রোটোপ্ল্যাজম যেখানে 
অলৌকিক বীজ নিয়ে অপেক্ষায়। মেঘজন্ম
ঈশ্বরের সাথে যে কথপোকথন সেরে নেই তার
সেরিব্রালের কথা বলে যেভাবে ভয় দেখায়
সেখানে প্রলাপ কিছু নেই নাভিমুল থেকে উঠে আসা
কিছু অভিমান। ঈশ্বরেরও চোখে জল এনে দেয়। 

তাঁবুর ভেতর থেকে বের হয়ে আসে আলটপকা উট 
দেখায় পিপাসাও হতে পারে মহাকাব্যিকধর্মী। কুঁজ
ফেরি করে যে জল অন্তত তার কোনো বাহানা নেই। 

হলুদ দাঁতের ফাঁকে যেটুকু ধরে রাখে বিনিপাত
সে তো নিজেরই গড়িয়ে পড়া আনত ভঙ্গিমায়। 
পথের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকে
অমলতাসধর্মী ভায়োলিন। মনখারাপের রিলিভার নিয়ে
এইসব থাকাগুলি বেজে ওঠার নীল অপেক্ষায়
শুয়ে থাকে চোখের পাতায় নিয়ে সবুজাভ ঘুম।



নির্বাচন


মায়াবী বন্দরের সঙ্গে কতটা মিল রয়েছে
গ্রাম্য ধানক্ষেতের?

এমন একটি প্রশ্ন নিয়ে যখন ছায়াপথের
উচিত ছিল তুলকালাম 
পরিবর্তে পায়েলের ঝনৎকারের রহস্য নিয়ে
মাথা ঘামানোতে কিছুমাত কৃতজ্ঞতা নেই
আলফা বিটা গামার 
বরঞ্চ ঝরে পড়তে থাকে বিহ্বল স্বপ্নের নষ্ট ফল

ধ্বনিত ভ্রম থেকে বায়ুভুক ঘোরতন্ত্র বেরিয়ে এসে
যদি চেয়ে বসে কুঞ্জবনের কৌলীন্য 
তবে শুধু পিচ্ছিল বাঁশে বাঁদরের প্রয়াস নিয়ে
কিছু স্যাটায়ারিক উপকথাই গড়ে উঠতে পারে
ধ্বন্যাত্মক আলো কিছুতেই আসতে চায়না কাছে
রাত ক্রমশ পিছলে সরে যেতেই থাকে হিস্টিরিয়ার দিকে

তবুও ধানক্ষেত তার আঙুল নেড়ে রেখে দেয়
মিলনসূত্র ও রতিহরিণীর ডাক
যার মঁশিয়ে বা মাদমোয়াজেল সম্পর্কে নেই কোনো জ্ঞান 
শুধু জানা আছে তার চর্যা পথের উপরেই
ছড়িয়ে পড়ে থাকে কক্ষপথ

একথা বন্দরে ভেসে আসা জলযান জানে
বাস্তবতার বায়োপিক জানেনা

রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

ওঁ শিবায় নমঃ 


আমাদের ড্রয়িংরুমে
এখনও পর্যন্ত কোন এয়ারপোর্ট নেই

আকাশ থেকে নামতে হলে
সামনে দো দুয়ার
পিছে দো দুয়ার

ধরো সামনের লোকটি উৎসমনা

আর ভরদুপুরে তোমারও একটি
বৎসমুখী প্রেম চাই

আমার পিগি ব্যাঙ্কের খুচরো বেকসুরগুলো
অগোচরে তাই তৎসৎ

ওঁ শিবায় নমঃ

নিবেদনের শালপাতাটি
কমসে কম

এখন সমুদ্রের নিচে
নিঃস্বে হোক উৎসর্গ

তাহলে আগে থেকেই  তাল কেটে রাখি

পরিখার  বিপরীতে
আমি তো আছিই

আধঘন্টা ধীরে
তুমিও কাছে এসো


দাঁড় টেনে গেছি স্রোতবরাবর



পা পাল্টে দাঁড়ালে
আমার  দাঁড়ি জীবনের
গুণগত তাপমান নিয়ে
অনেক হালখাতা হয়

কমা, পূর্ণচ্ছেদের ওপর
হাওয়ামহল পালগুলো

মন ঘুরে গেলে
একটাই দিকচিহ্নহীন আন্তর্জাতিক রাস্তা

ঝাউগাছের রোদ্দুর
মাইলস্টোনে ছায়া ফেলে না

অথবা ফুটপাথের ওপর দিয়ে
ওই যে আবর্তহীন আপাতসংরক্ষণ

ঘুমোনোর আগে পর্যন্ত
চলতেই থাকে
চলতেই থাকে

দাঁড় টেনে গেছি স্রোতবরাবর
নবরাত্রি  ছিল তোমার হাতে

নাকি এগুলো  নিটোল
স্বপ্নভাঙা কলার টিউন

ফলতঃ আমি এখন টয়ট্রেনের
মহাজাগতিক রশ্মি

সৌমিত্র রায়

শব্দ'৭।।আমছেঁচকির দুপুর


আমছেঁচকির দুপুরে

    সিরিয়াল।কার্টুন ফেসবুক~
     
        টকঝাল-->বিলোচ্ছে

শব্দ'৬।।খেলনা

সাঁ। ঝ। বা। তি।র-->আলো

    খেলতে থাকে।

                      ।বাবানের খেলনায়




জন্ম।।ক্রমাগত সুন্দেরর 

স্ত্ততি চ্যাট

জন্ম।। ক্রমাগত সুন্দরের-প্রজাপতির ডানায় ভর করে--বিকেলের রোদ্দুর--চরে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়--গোগ্রাসে শুষে নিচ্ছে তরঙ্গায়িত সৌন্দর্য--নিজের থেকে উজাড় করে দিচ্ছে--তরঙ্গ-সুন্দরের-ধানকাটা মেঠো নির্জনতায়--লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ঘাসফড়িং--পুজো করা ধানের আটি মাথায়--শাঁখ ফুঁকে--খামারে ফিরছে বালক--মাঠে ছড়ানো চিঁড়ের ভোগে--আনন্দের ঠোঁট রাখছে পাখি--তার ডানার অভ্যাস-ঘাসফড়িং-এর লাফানোর অভ্যাসে-ক্রমাগত!

এখন।। বিকেল ৪টা ১৩মিনিট, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬--মেদিনীপুরের জামবাগানে আছি--বিকেলের কাব্যযোগে--কাব্যযোগ-i-চিন্তনের--সবার জন্য কাব্যযোগ--সুন্দরের জন্য--শান্তি আনন্দের জন্য--সুন্দরের-ক্রমাগত-জন্ম-তরঙ্গ প্রবাহ-শান্তি আনন্দের-ঘুরে দাঁড়িয়েছি--রোগ হতাশা অবসাদের বিরুদ্ধে--ফিরেছি আনন্দে-আনন্দ!

আনন্দ।। ক্রমাগত, অভ্যাস;আমাদের অভ্যাসের প্রভাবেই প্রভাবিত জীব ও প্রকৃতি;মানবজীবন এখন দ্রুততার,যা চাই, এখনি চাই;গতি,গতি,গতিতে ক্রমাগত ভুলি গন্তব্য ;অদূরেই ধানকাটা মেশিনের চাকায় ঘুরপাক খাচ্ছে পুরানো ৫০০ বা হাজার নোটের স্মৃতি;জীবন মানেই কি শুধুই গতি আর মুদ্রার স্মৃতি,এসো ফিরি গন্তব্যে, পবিত্রতা সুখ আর শান্তিতে;জ্যোতির স্মৃতিতে ফিরি, অভ্যাস বদলে ক্রমাগত জন্ম দিই সুন্দরের,কাব্যে কাব্যে ঘোরে-ফেরে চিন্তন,শান্তিতরঙ্গে মেশে।।শান্তি।।

দীপ্তি চক্রবর্তী

                শেষ খেয়া
                

         সারা উঠোন জুড়ে খেলা করছে বৃষ্টি। থৈথৈ করছে জল,জলের ছোটো ছোটো স্রোত বইছে এদিক ওদিক।বাচ্চাটা দাওয়ার একধারে বসে ভাসাচ্ছে কাগজের নৌকো।

      উঠোনের একপ্রান্তে বসানো চারা গাছ মাথা দোলাচ্ছে আর ভাবছে সামনের বছর আর জলের এই স্রোত ওদের কাবু করতে পারবে না। এখন ওদের জীবন সংগ্রামে লড়তে দেখছি সারা দিন রাত। 

    বাগানে গন্ধরাজ গাছ তীব্র গরমে ফুল দিয়ে সুগন্ধে  আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো ক্লান্ত শরীর। আজ ওর মাথায় দেখছি কচি কচি পাতা এসেছে। চাঁপা গাছটিতে ফুল কম হচ্ছে। কেন জানিনা ওর একটু অভিমান হয়েছে।ওর পাশে রয়েছে একটি বাবলা গাছ।

        মাঠের জল এসেছে বলে চাষীরা আনন্দে ভরপুর । আলুতে এবারে লাভ হয়নি । ধান তো রুইতে হবে। নেমে পড়েছে মাঠে কোমর বেঁধে। 

      ভোরের বেলায় উঠোনময় বিছিয়ে পড়ে থাকছে শিউলি ফুল। যেন বলে যাচ্ছে মায়ের আগাম আগমন বার্তা। মায়ের নাকি এবারে নৌকায় আগমন।  

        দূর থেকে শুনছি করা যেন কথা বলতে বলতে যাচ্ছে নদীর খেয়া পারাপার আজ বন্ধ যাবে। তাই যারা ফিরবে এটাই আজকের মতো শেষ খেয়া। আহা কতো রূপেই না কথার বিচ্ছুরণ।
.........."খেয়া পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে
                 ওগো যাসনে গো তোরা 
                    যাসনে ঘরের বাহিরে।"




  ঘূর্ণন


একটা আমি র ভিতর একটা ঈশ্বর
অস্ফুটে এক বিশ্লিষ্ট চেতনা

বালির নদী থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছি
কিছু মুক্তহীন ঝিনুক

সেকেন্ডের কাঁটার ঘূর্ণনে আলোর ফোঁটা

প্রজাপতি সময়ের অবক্ষেপ জমে চলেছে

রাস্তার পাশে  শ্মশানের স্তব্ধতায়
চিরহরিৎ জীবনের ভিড়
খুঁজে চলেছি জীবাশ্মের সন্তান



সৌম্যদীপ রায়

ঈশ্বরের প্রতি


এমন এক শূন্যতার মধ্যে দিয়ে হাঁটছি যে নিজের পা ফেলার শক্তিক্ষয় থেকে আর প্রতিধ্বনি গজিয়ে উঠছে না আজকাল, তার মানে অবশ্যই এই নয় যে আমার আর ঈশ্বরের মধ্যেকার ফারাক আমি ঘুচিয়ে এনেছি। 
আমি হয়তো ঠিক উলটো দিকে এক নিরীশ্বরবাদীতার জঙ্গল দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা পোষা বাঘের খোঁজে নিজেকে নির্ঝঞ্ঝাট ঝর্নার মত আছড়ে ফেলতে পারলে বেশি খুশি হতাম, কিন্তু সব বিশেষণের খোঁজে আমি একা বের হতে পারবো না, সেই শক্তি আমার জীবন্তিকায় নেই। তাই মাঝে মাঝে...



আলো-

১ 

বিভাগীয় অনুচ্ছেদ আলোর প্রতিসরণের সংজ্ঞা রক্ষা করলেও প্রতিবিম্বর ভেতরকার রক্ষণশীল আলোকরশ্মি যেভাবে বাইরে আসতে চায় সেখানে কিছু আনুষঙ্গিক সম্পর্ক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে অপেক্ষা করে। আমার সঙ্গে তোমার চলাফেরার মধ্যে যতটুকু ডিগ্রীর বেখেয়ালি পথ তার মধ্যে অংক নেই, চাইলে বাইরের কেউ অংকন করতেও পারে, সেটা ঠিক হবে কি ঠিক হবে না এর উত্তর আমি উপসংহারে বলব ভেবেছি। তুমি কিছু মনে করলেও আমার সব অনুস্বর এর উপর একদিন চন্দ্রবিন্দু বসবে, বসবেই।



যখন প্রিজমকে ধাক্কা মারে আলোর শব্দরা তখন কিছুকিছু বিচ্ছুরিত মনোভাব সেই চৌহদ্দির ভেতরেই আটকে থেকে যায়। তারপর একটার পর একটা ধাক্কা, প্রতিফলন,  বেড়াজাল। ক্রমশ নিংড়ে নেয় সব বাকশক্তি, বাকশৈলীর যে নিজেদের ফ্রিকোয়েন্সি সব ধামাচাপা পড়ে অন্তঃবৃত্তিও কিছু ব্যাসার্ধের আঙ্গিকে। যে শব্দরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিল তাঁরা বাইরে থেকে এই খেলা দেখে আর দেখে।






শিবাজী সেন

         ফেরা 

                                

     মাঝে মাঝে ভাবি, চারপাশটা কেমন স্বপ্নের মতো পলকে পালটে গেল। হঠাৎ করেই সবাই কেমন বড় হয়ে গেলাম, ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এতটাই ব্যস্ত যে, ফেলে আসা শৈশবটাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমাদের নেই। 
     কিন্তু আমি জানি---আমি নিশ্চিত যে, প্রত্যেকটা সুস্থ মনের মানুষই দিনে একবার হলেও তার এই হারানো সোনার দিনগুলোর কথা ভাবে। আর তা হল, রাতে---সব কাজ শেষে---আলো নিবিয়ে---বিছানায় শুয়ে---চোখ বন্ধ করে...এই সময়টা তার নিজের সময়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সময়। 
     যদিও বিবাহান্তে এই ব্যক্তিগত সময়টাতেও ভাগ বসাতে থাকে স্ত্রী---তবু মানুষ কিভাবে তার এই সোনালি শৈশবকে সম্পূর্ণ ভুলে থাকতে পারে!
     অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেছি শৈশবের কিছুটা ঘ্রাণ আবার ফিরিয়ে আনতে। বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে একদিন ক্রিকেট খেললাম। কিন্তু বয়সকে এড়াবো কি করে ? আগের মতো সেই দম আর নেই। অল্পেতেই সবাই হাঁফিয়ে পড়লাম; খেলা জমল না।
     দলবদ্ধ ভাবে একদিন পুকুরে গেলাম জলে বেশ একচোট হুড়াবো বলে। কিন্তু পুকুর-ঘাটে পৌঁছে বেশিরভাগেরই আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হল। এই বয়সে জলে হুড়ানো...! ছি ছি, লোকে কি বলবে ? 
     লজ্জায় অনেকে জলেই নামল না, কোনো রকমে দু’চারটে ডুব দিয়ে স্নান সারলো কয়েকজন। 
     এক সময় অন্তত ঘন্টা দুই পুকুরে না হুড়োলে যাদের দিন কাটত না, তাদের কারও এখন পুকুরের জলে এলার্জি হয়, কারও বা সর্দি-কাশির ভয়। 
     আসলে আমরা বড় হয়ে গেছি...অনেক বড়। আমাদের একটা সামাজিক অবস্থান তৈরি হয়েছে---আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং লজ্জাবোধ তৈরি হয়েছে। আর এই আত্মমর্যাদার কাছে শৈশব হয়ে গেছে মূল্যহীন, গুরুত্বহীন একপ্রকার ন্যাকামিমাত্র। 
     অনেক চেষ্টার পর এটা আমি বুঝেছি যে, সময়কে ধরে রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই তা একবার চলে গেলে আর ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়।
     বয়সের সাথে সাথে আত্ম ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘ কয়েক বছর হল রঙ-খেলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। রাধা-কৃষ্ণের এই পবিত্র প্রেমলীলার উৎসবে সখী এবং গোপিনিরা বর্তমানে যে সকল রঙগুলি ব্যবহার করে থাকেন তা নাকি তীব্র চর্মনাশা। ফলে এই দিনটিতে সারাদিনই কোনো কাজ থাকে না। একা একা পুরনো স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়াই...
     এ বছর রং-খেলার দিনটাও একই ভাবে কাটছে। কি করি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। এক পা দু’পা করে বাড়ির পিছন দিকের বাঁশ বাগানটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 
     অনেক প্রাচীন বাঁশ বাগান---কত চেনা-অচেনা পাখি, সরীসৃপ আর বন্য প্রাণীর নিরাপদ ও শান্তিময় আশ্রয়। প্রতিটা বাঁশই অত্যন্ত মোটা ও গগনচুম্বি। তাদের গা বেয়ে মোটা মোটা বুনো লতা পাকিয়ে উঠে গেছে প্রায় ডগা পর্যন্ত। তলায় এখানে ওখানে বুনো ঝোপ-ঝাড় আর শেয়াল, বনবেড়াল, বেজি, গেছো ইঁদুর প্রভৃতির বড় বড় চালা। বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে বয়স্ক গাব, সেকুল, সাগু, ড্যাবোল, বুনো আমড়া আর জলপাই গাছ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুপারি, তাল, নারকেল আর বেঁটে আম গাছও কিছু আছে। বাকিটা বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতায় ঢাকা। দিন-রাত বাতাসের মর্মর্ধ্বনি। সারা বছর একই রকম ছায়াশীতল। 
     এক পাশ দিয়ে চলে গেছে, সমস্ত বাড়ির জল নিকাশির জন্য চওড়া খানা। দুই পাড়ের নরম মাটিতে দাঁড়াশ-জলধোঁড়া-হেলে প্রভৃতি নির্বিষ সাপের অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। 
     শুনেছি আমার জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা, পিসিমারাও নাকি এই বাঁশবনে এক কালে খেলা করেছেন---তারপর আমার জ্যাঠতুতো দাদা-দিদিরা---আর তারপর আমি ও আমার খুড়তুতো ভাইরা। এখন ভাইপো-ভাইঝিদের দখলে। এরপর হয়তো একদিন এদের ছেলে মেয়েরাও এখানে খেলবে ! 
     কত প্রজন্ম, কত স্মৃতি---সেই বাঁশবন... 
     একে একে কতই দৃশ্য, কতই না শব্দ, কতই না কথা চোখ ও কানে ভেসে উঠল। আবার তারা একে একে মিলিয়েও গেল। 
     একটা দিনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তখন ক্লাস ‘টু’ কি ‘থ্রি’-তে পড়ি। আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা সুধীন সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ত সে সময়। তারই কান্ড...
     সন্ধের পর পড়াশুনো সেরে আমরা জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো মিলে মোট ছয়-সাতটি ভাই-বোন ছুটতাম ঠাকুমার কাছে। তাঁর কাছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনাই ছিল সে সময় আমাদের একমাত্র বিনোদন। এর কাছে এখনকার হিন্দি ছবির অসার নাচা-গানা-পাগলামো কোথায় লাগে !
     মহাভারতে এতটাই অভিভূত হয়েছিলাম যে, আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মহাভারতের একেকটি চরিত্র ভেবে নিয়েছিলাম, আর বাঁশতলাটাই হয়ে উঠেছিল আমাদের কুরুক্ষেত্র।
     আমার ছোট কাকা তখনও পড়াশুনো করতেন। তিনিই ছিলেন আমাদের অস্ত্রপ্রস্তুতকারক। বাঁশের কঞ্চি বাঁকিয়ে তার দুই মাথা দড়ি দিয়ে টানটান করে বেঁধে তৈরি হত ধনুক। অন্য একটি কঞ্চির মাথা সুঁচালো করে তৈরি হত তির।
     আমার এই কাকাটি ছিলেন আমাদেরই মতো আত্মভোলা---বেহিসাবি। কাকার ছিল প্রচন্ড ভ্রমণের নেশা। সারা পৃথিবীর মানচিত্র তিনি গুলে খেয়েছিলেন। সংসারে থাকার লোক তিনি ছিলেন না। অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি আর ভ্রমণের নেশা, এই দুইয়ের টানে কাকা ঘর ছাড়লেন। তাঁর আর কোন খোঁজ পাইনি। তিনিও আর কখনও যোগাযোগ করেননি। 
     ঠাকুরদাদা অনেক আগেই গত হয়েছিলেন, তখন ঠাকুমাও গত হয়েছেন। জ্যাঠা–কাকারা প্রত্যেকেই নিজেদের সংসার সামলাতে ব্যস্ত। কেউই কাকাকে খোঁজবার তেমন তাগিদ দেখালেন না। 
     কাকার জন্য আমার বড় মন খারাপ লাগত। কাকা একবার আমায় আফ্রিকার মাটাবেল-মাশাইদের দুর্ধর্ষ শিকার-কাহিনী শুনিয়ে বলেছিলেন তিনি আফ্রিকা চলে যাবেন। তারপর আমি বড় হলে আমাকেও সঙ্গে নেবেন। আমি ছোট কাকার সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরব। 
     কাকা কি তাহলে এখন আফ্রিকায় ? কে জানে...
    
     রবিবারের সকাল, দলবদ্ধ ভাবে কুরুক্ষেত্র, অর্থাৎ বাঁশতলায় উপস্থিত হলাম অস্ত্র-শস্ত্র সমেত।
     আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দুটি দল ভাগ হল---পান্ডব আর কৌরব। আমি পড়লাম পান্ডব পক্ষে। আমার চরিত্র হল ‘শ্রীকৃষ্ণ’। আমায় যুদ্ধ করতে হবে না, শুধু অর্জুনরূপী জ্যাঠতুতো দাদাটিকে কিছু উপদেশ ও পরামর্শ সরবরাহ করতে হবে। 
     যাইহোক, আমরা যে যার অবস্থান ঠিক করে নিলাম বাঁশ বাগানের দুই প্রান্তে। কেউ বাঁশঝাড়ের পিছনে, কেউ বা আপন ইচ্ছায় বেড়ে ওঠা কোন গুল্মের আড়ালে, কেউ আবার আগাছা ঝোঁপের পিছনে।
     প্রথমে দুই পক্ষের মধ্যে কিছুক্ষণ আক্রমণাত্মক সংলাপ বিনিময় চলল। যুদ্ধের পরিবেশ রচনায় এটাই নাকি নিয়ম।
     স্বর-বিনিময় শেষ হলে শুরু হল শর-বিনিময়। দু’পক্ষের সেনাপতিদের নির্দেশে শুরু হল যুদ্ধ। দু’পক্ষেরই বাঁশ গাছ, কলা গাছ, গাব গাছ, সুপারি গাছের গায়ে নিরন্তর তির আছড়ে পড়তে লাগল। 
     এরপর এক সময়, কাহিনী অনুসারে কৌরবপক্ষিয় রথি-মহারথিদের পতন শুরু হল এবং কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেল। 
     এখানে কর্ণ-চরিত্রধারী আমার প্রায় সমবয়সি খুড়তুতো ভাই প্রতীম কর্ণোচিত বিচক্ষণতা দেখাল। আমাদের বাড়িতে গোলাম মিঞা নামে এক ঠিকা শ্রমিক নিয়মিত কাজ করত। তার একটিমাত্র সম্পত্তি ছিল বড় জ্যাঠামশাইয়ের কিনে দেওয়া একখানা পুরনো, পাটাতন ভাঙ্গা তিন চাকার ভ্যান-রিক্সা। কাজ শেষে সে বাগান থেকে কাঠ, পাতা লতা ভ্যান বোঝাই করে বাড়ি ফিরত জ্বালানির জন্য। মাঝে মাঝে ভাড়াও খাটাত। ভ্যানটি সে সাধারণত বাঁশতলাতেই রেখে দিত। তাতে এটি সারাদিন ছায়া পেত আর নিরাপদেও থাকত।
     পূর্বপরিকল্পিত না হলেও কর্ণ তাৎক্ষণিক সেটিকেই তার রথ ভেবে নিল এবং তার পিছনের বাম দিকের চাকাটি ধরে ঠেলাঠেলি করতে লাগল মাটি থেকে তোলার জন্য। সঙ্গে বলতে লাগল, ‘আমার রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে, যতক্ষণ না তা আমি তুলতে পারছি ততক্ষণ যুদ্ধ বন্ধ রাখ।’
     আমি শ্রীকৃষ্ণ; অর্জুনের প্রধান উপদেষ্টা এবং তার রথের সারথি। নিতান্ত রথটা নেই বলে তা চালানোর দায়িত্ব নেই। তবে উপদেশ দেওয়াটা আমার কর্তব্য। তা না দিলে কর্তব্যে অবহেলা হয়। 
     তাই অর্জুনকে পরামর্শ দিলাম, ‘চালাও তির, এইই সুযোগ, তা না হলে তুমি কর্ণের সাথে সম্মুখসমরে পেরে উঠবে না।’
     অর্জুন সম্মত হল না। এ কাজ ক্ষাত্রধর্মবিরোধী---নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আক্রমণ কাপুরুষোচিত কর্ম। উপরন্তু ব্যক্তিটি আবার সম্পর্কে তার ভাই। সে ভ্রাতৃহন্তা হতে নারাজ। 
     তখন আমি উপদেশ দিলাম, ‘ওরে পাগল, তুমি যে নিমিত্তমাত্র, আসল কাজ তো আমিই করে রেখেছি। যাদের তুমি জীবিত ভাবছ তারা সকলেই আসলে মৃত। তুমি হত্যা করলেও এরা মৃত, না করলেও মৃত। আর তাছাড়া যাদের তুমি তোমার ভ্রাতা ভাবছ তারা আসলে তোমার শত্রু, তোমার প্রতিপক্ষ। সুতরাং কালব্যয় না করে শর নিক্ষেপ কর।’
     অবশেষে অর্জুন রাজি হল। কিন্তু তার হাতের নিশানা যে কিরূপ প্রাণঘাতী তা আমার ধারণা ছিল না। থাকলে আমি তাকে এ উপদেশ এবং পরামর্শ কখনই দিতাম না। 
     অর্জুনের বাণ কর্ণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গিয়ে বিঁধল তার রথের চাকায়। ওমনি গোলামের ছায়ায় এবং নিরাপদে থাকা ভ্যান-রিক্সার পিছনের বাম দিকের চাকাটি থেকে শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া নির্গত হতে লাগল। 
     এ দৃশ্য দেখে একযোগে পান্ডব এবং কৌরব সকল মহারথিরই বদন গোলামের ভ্যান-রিক্সার চাকাটির মতোই চুপসে গেল। 
     গোলাম ছিল বড় জ্যাঠামশাইয়ের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এবং সে ছিল অতি দরিদ্র। এই ভ্যান-রিক্সাটাই তার একমাত্র সম্বল। ফলে গোলামের এই সম্বলটির আক্রান্ত হওয়ার খবর জ্যাঠামশাইয়ের কানে পৌঁছালে আমাদের যে কি পরিণতি হবে, তা ভেবে সকলেই বিচলিত হয়ে উঠলাম।
     আমাদের মধ্যে সুধীনই ছিল বয়সে বড়, ফলে তার ঘটে বুদ্ধিও ছিল বেশি। সে আমাদের পরামর্শ দিল, ‘এখানে আর না, ঘাটে গিয়ে পড়া যাক, তারপর একটা কিছু ঠিক করা যাবে।’
     ঘাটে গিয়ে এ ঘটনার কথা আর কারওরই মনে রইল না। জলে হুড়োহুড়ি আর কাদা ছোড়াছুড়ি করতেই এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। ভেবে আর কিছুই ঠিক করা হল না। 
     বাড়ি ফিরে দেখি জ্যাঠামশাই বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে আর তাঁর পিছনে জেঠিমা। বারান্দার নিচে, উঠোনে দাঁড়িয়ে গোলাম কাতর মুখে কিছু অনুযোগ করছে। তার পাশেই ছোট কাকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বড় জ্যাঠামশাইয়ের ক্রোধান্বিত মুখভঙ্গি দেখে বুঝলাম আমাদের ভাগ্যাকাশে বিপদের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, তার পূর্বেকার দমকা হাওয়া বয়ে গেছে ছোট কাকার উপর দিয়ে।
     সন্ধের কিছু পরেই যথারীতি আসামিদের ডাক পড়ল। যে যার বই খাতা ফেলে রেখে এক ছুটে হাজির হলাম জ্যাঠামশাইয়ের এজলাসে। কে জানে, বিলম্বে যদি আবার শাস্তির আধিক্য ঘটে !
     জ্যাঠামশাই হাতে একটা লম্বা বেতের লাঠি নিয়ে ব্যস্ত ভাবে পায়চারি করছিলেন। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে ক্রুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘গোলামের ভ্যানের চাকায় কাটি ফুটিয়ে চাকা ফুটো করে দিয়েছে কে...সত্যি কথা বল।’
     ভয়তে আমার হৃদ্‌যন্ত্রটি সবেগে ধাবিত হতে লাগল, কান দুটি প্রচন্ড রকম গরম আর লাল হয়ে উঠেছে, চোখ দিয়ে জল প্রায় বেরিয়েই পড়েছিল। কিন্তু এত বিপর্যয়ের মধ্যেও, অন্যদের কথা জানি না, জ্যাঠামশাইয়ের প্রশ্ন শুনে মনে মনে আমার ভীষণ হাসি পেল। অর্জুনের মতো মহারথির লক্ষ্যভেদি বাণ কিনা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে হয়ে গেল ‘কাটি’...!
     কারও মুখে কোন উত্তর নেই, সকলেই নির্বাক্‌ হয়ে মাথা নিচু করে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। গরম কালের সন্ধে, গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি, মাঝারি মাপের ঘরটার দুই প্রান্তে দুটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে। এই হলদে-কোমল আলো-আঁধারির মায়াময় স্বপ্নালুতায় আমরা নির্বাক্‌-নতমস্তক-সারিবদ্ধ। আমাদের সম্মুখে জ্যাঠামশাই, তিনিও বাক্যহীন। মনে হল যেন চার্চে পাদ্রির সামনে দাঁড়িয়ে কোনো বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় মোমবাতির নরম আলোয় আমরা প্রার্থনা করছি।
     অনেকক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় কেমন একটা আচ্ছন্নতার ভাব হয়েছিল। তার মধ্যেই পুনরায় জ্যাঠামশাইয়ের হুঙ্কার কানে এল, ‘কি রে উত্তর দিচ্ছিস না যে, কথা কানে যাচ্ছে না ?’
     তবু কোনো উত্তর নেই...
     জ্যাঠামশাই যখন বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও উত্তরের কোনো আশা দেখলেন না তখন অবশেষে শাস্তি ঘোষণা করলেন, ‘সব ক’টা নিলডাউন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়। যতক্ষণ না মাথা ঘুরে পড়ছিস ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি। কেউ যদি উঠেছিস তো এই বেত ভাঙ্গব তার পিঠে।’
     এখানে বলে রাখি ‘নিলডাউন’ হল অত্যন্ত কর্কশ অথচ বহু কঠিন রোগের অব্যর্থ মহৌষধী। এর প্রক্রিয়া হল---হাত দুটিকে পিছন থেকে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে, মাজা ভেঙ্গে কান দুটি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে অন্তহীন মুক্তির অপেক্ষা। আবিষ্কর্তার নাম অজানা...
     এটাকে এক প্রকার মানহানিকর যোগব্যায়ামও বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগ অনুযায়ী ঔষধের কার্যকারিতা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘নিলডাউন’ অবস্থায় পিঠের উপর ইট বা ঐ জাতীয় ভারী পদার্থ চাপিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের অসুখ মনে হয় ততটা কঠিন ছিল না।
     কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম ঔষধ কাজ করছে এবং আমরা এতক্ষণ কার আত্মার শান্তি কামনা করছিলাম তাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। 
     মাথা ঘুরল না বটে, তবে অল্পক্ষণেই মনে হল ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। পা’দুটি ভীষণ ভাবে কাঁপতে লাগল। 
     কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন। কম্পমান দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখলাম বারান্দা দিয়ে ঠাকুমা এদিকেই আসছেন। পিছনে কিছু তফাতে জেঠিমা, তবে তিনি আসছেন না, একটু অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম তাঁর পক্ষে জ্যাঠামশাইয়ের মোকাবিলা করে আমাদের মুক্ত করা সম্ভব নয় বুঝেই ঠাকুমার শরণ নিয়েছেন।
     বড় জ্যাঠামশাই ছিলেন বাড়ির অভিভাবক। অত্যন্ত রাশ ভারি অথচ বিচক্ষণ মানুষ। বাবা-কাকারা সকলেই তাঁকে সমীহ করতেন, ভক্তিও করতেন। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর কারও কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। 
     বাড়ির সমস্ত কচি-কাঁচাদের আবদার সামলাতেন বড় জেঠিমা।
     কিন্তু জ্যাঠামশাই এত রাশভারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কোন দিন আমরা ঠাকুমার মুখের উপর কথা বলতে শুনিনি। বরং যে কোনো কাজ করতে হলে তিনি আগে যেতেন ঠাকুমার কাছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। 
     অতএব, ঠাকুমা আমাদের সার্বজনীন ত্রাতা। 
     ঠাকুমা এসে জ্যাঠামশাইয়ের শাসনের হানাবাড়িটিকে শূন্যে মিলিয়ে দিলেন, ‘কি রে বলাই, এই দুধের শিশুগুলোকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছিস কেন ?’
     ‘মা, এরা গোলামের কত বড় ক্ষতি করেছে তুমি জান না। বেচারা গরিব মানুষ, তার ভ্যানের চাকাটা ফাটিয়ে দিয়েছে ! ও এখন কি করে মেরামত করাবে ? দিন দিন এদের উপদ্রব বেড়েই চলেছে।’
     ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন, ‘তুই যেন ছেলেবেলায় খেলা করতে গিয়ে কোনো ক্ষয়ক্ষতি করিসনি, অ্যাঁ...! আমার আচারের শিশি ভেঙ্গে কি কান্ড করেছিলি বলব এদের ?’
     এ কথায় জ্যাঠামশাই অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। তিনি চাপা স্বরে বললেন, ‘মা, কি যে বল না বাচ্চাগুলোর সামনে ! আচ্ছা, ওর ভ্যানের মেরামতির খরচ আমি কাল দিয়ে দেব।’
     এরপর আমাদের মুক্তি আর আটকায় কে ? সেখানে আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে এক ছুটে যে যার ঘরে চলে গেলাম। শুধু আসার আগে জ্যাঠামশাই বললেন, ‘কাল থেকে যার হাতে ঐ লাঠি-কঞ্চি দেখব তার পিঠেই ভাঙ্গব, বুঝেছ ?’
     এরপর সত্যিই আর তির-ধনুক হাতে নেওয়া হয়নি। জ্যাঠামশাইয়ের ভয়তে লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু দিন খেলা হয়েছিল, কিন্তু সে খেলা আর তেমন জমত না।
     এর বছরখানেকের মধ্যে ঠাকুমা গত হলেন। মাস কয়েক পরেই ছোট কাকা ঘর ছাড়লেন। আমাদের গল্প শোনানোর আর তির-ধনুক তৈরি করে দেওয়ার আর কেউ রইল না। 
     আমরাও বড় হলাম। রামায়ণ-মহাভারতের সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়ল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আর টেলিভিশনের দৌলতে ঘনিষ্ঠতা হল ক্রিকেট-ফুটবলের সাথে। সোনালি দিনগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল... 
     আজ ঠাকুমা নেই, জ্যাঠামশাই নেই, জেঠিমা নেই, সুধীন দা চাকরীসূত্রে সপরিবার ভিনরাজ্যবাসী। ছোট ভাইগুলো কেউ বা কাজের তাগিদে, কেউ বা পড়াশুনোর খাতিরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বোনগুলির কয়েকটির বিয়ে হয়ে গেছে, কয়েকটির তোড়জোড় চলছে। আমি নিজেও জীবিকার তাড়নায় নগরবাসী হয়েছি। মাসে দু’এক দিন বাড়ি আসার সুযোগ পাই, কোনো মাসে তাও হয় না।
     অনেক চেষ্টা করেও আর আমরা এক জায়গায় হতে পারিনি। কারণ আমরা এখন ব্যস্ত, আমাদের সময় নেই। আমরা বড় হয়ে গেছি...অনেক বড়।

                                                               -----  ০০০  -----