Friday 1 September 2017

শিবাজী সেন

         ফেরা 

                                

     মাঝে মাঝে ভাবি, চারপাশটা কেমন স্বপ্নের মতো পলকে পালটে গেল। হঠাৎ করেই সবাই কেমন বড় হয়ে গেলাম, ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এতটাই ব্যস্ত যে, ফেলে আসা শৈশবটাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমাদের নেই। 
     কিন্তু আমি জানি---আমি নিশ্চিত যে, প্রত্যেকটা সুস্থ মনের মানুষই দিনে একবার হলেও তার এই হারানো সোনার দিনগুলোর কথা ভাবে। আর তা হল, রাতে---সব কাজ শেষে---আলো নিবিয়ে---বিছানায় শুয়ে---চোখ বন্ধ করে...এই সময়টা তার নিজের সময়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সময়। 
     যদিও বিবাহান্তে এই ব্যক্তিগত সময়টাতেও ভাগ বসাতে থাকে স্ত্রী---তবু মানুষ কিভাবে তার এই সোনালি শৈশবকে সম্পূর্ণ ভুলে থাকতে পারে!
     অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেছি শৈশবের কিছুটা ঘ্রাণ আবার ফিরিয়ে আনতে। বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে একদিন ক্রিকেট খেললাম। কিন্তু বয়সকে এড়াবো কি করে ? আগের মতো সেই দম আর নেই। অল্পেতেই সবাই হাঁফিয়ে পড়লাম; খেলা জমল না।
     দলবদ্ধ ভাবে একদিন পুকুরে গেলাম জলে বেশ একচোট হুড়াবো বলে। কিন্তু পুকুর-ঘাটে পৌঁছে বেশিরভাগেরই আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হল। এই বয়সে জলে হুড়ানো...! ছি ছি, লোকে কি বলবে ? 
     লজ্জায় অনেকে জলেই নামল না, কোনো রকমে দু’চারটে ডুব দিয়ে স্নান সারলো কয়েকজন। 
     এক সময় অন্তত ঘন্টা দুই পুকুরে না হুড়োলে যাদের দিন কাটত না, তাদের কারও এখন পুকুরের জলে এলার্জি হয়, কারও বা সর্দি-কাশির ভয়। 
     আসলে আমরা বড় হয়ে গেছি...অনেক বড়। আমাদের একটা সামাজিক অবস্থান তৈরি হয়েছে---আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং লজ্জাবোধ তৈরি হয়েছে। আর এই আত্মমর্যাদার কাছে শৈশব হয়ে গেছে মূল্যহীন, গুরুত্বহীন একপ্রকার ন্যাকামিমাত্র। 
     অনেক চেষ্টার পর এটা আমি বুঝেছি যে, সময়কে ধরে রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই তা একবার চলে গেলে আর ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়।
     বয়সের সাথে সাথে আত্ম ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘ কয়েক বছর হল রঙ-খেলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। রাধা-কৃষ্ণের এই পবিত্র প্রেমলীলার উৎসবে সখী এবং গোপিনিরা বর্তমানে যে সকল রঙগুলি ব্যবহার করে থাকেন তা নাকি তীব্র চর্মনাশা। ফলে এই দিনটিতে সারাদিনই কোনো কাজ থাকে না। একা একা পুরনো স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়াই...
     এ বছর রং-খেলার দিনটাও একই ভাবে কাটছে। কি করি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। এক পা দু’পা করে বাড়ির পিছন দিকের বাঁশ বাগানটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 
     অনেক প্রাচীন বাঁশ বাগান---কত চেনা-অচেনা পাখি, সরীসৃপ আর বন্য প্রাণীর নিরাপদ ও শান্তিময় আশ্রয়। প্রতিটা বাঁশই অত্যন্ত মোটা ও গগনচুম্বি। তাদের গা বেয়ে মোটা মোটা বুনো লতা পাকিয়ে উঠে গেছে প্রায় ডগা পর্যন্ত। তলায় এখানে ওখানে বুনো ঝোপ-ঝাড় আর শেয়াল, বনবেড়াল, বেজি, গেছো ইঁদুর প্রভৃতির বড় বড় চালা। বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে বয়স্ক গাব, সেকুল, সাগু, ড্যাবোল, বুনো আমড়া আর জলপাই গাছ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুপারি, তাল, নারকেল আর বেঁটে আম গাছও কিছু আছে। বাকিটা বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতায় ঢাকা। দিন-রাত বাতাসের মর্মর্ধ্বনি। সারা বছর একই রকম ছায়াশীতল। 
     এক পাশ দিয়ে চলে গেছে, সমস্ত বাড়ির জল নিকাশির জন্য চওড়া খানা। দুই পাড়ের নরম মাটিতে দাঁড়াশ-জলধোঁড়া-হেলে প্রভৃতি নির্বিষ সাপের অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। 
     শুনেছি আমার জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা, পিসিমারাও নাকি এই বাঁশবনে এক কালে খেলা করেছেন---তারপর আমার জ্যাঠতুতো দাদা-দিদিরা---আর তারপর আমি ও আমার খুড়তুতো ভাইরা। এখন ভাইপো-ভাইঝিদের দখলে। এরপর হয়তো একদিন এদের ছেলে মেয়েরাও এখানে খেলবে ! 
     কত প্রজন্ম, কত স্মৃতি---সেই বাঁশবন... 
     একে একে কতই দৃশ্য, কতই না শব্দ, কতই না কথা চোখ ও কানে ভেসে উঠল। আবার তারা একে একে মিলিয়েও গেল। 
     একটা দিনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তখন ক্লাস ‘টু’ কি ‘থ্রি’-তে পড়ি। আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা সুধীন সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ত সে সময়। তারই কান্ড...
     সন্ধের পর পড়াশুনো সেরে আমরা জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো মিলে মোট ছয়-সাতটি ভাই-বোন ছুটতাম ঠাকুমার কাছে। তাঁর কাছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনাই ছিল সে সময় আমাদের একমাত্র বিনোদন। এর কাছে এখনকার হিন্দি ছবির অসার নাচা-গানা-পাগলামো কোথায় লাগে !
     মহাভারতে এতটাই অভিভূত হয়েছিলাম যে, আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মহাভারতের একেকটি চরিত্র ভেবে নিয়েছিলাম, আর বাঁশতলাটাই হয়ে উঠেছিল আমাদের কুরুক্ষেত্র।
     আমার ছোট কাকা তখনও পড়াশুনো করতেন। তিনিই ছিলেন আমাদের অস্ত্রপ্রস্তুতকারক। বাঁশের কঞ্চি বাঁকিয়ে তার দুই মাথা দড়ি দিয়ে টানটান করে বেঁধে তৈরি হত ধনুক। অন্য একটি কঞ্চির মাথা সুঁচালো করে তৈরি হত তির।
     আমার এই কাকাটি ছিলেন আমাদেরই মতো আত্মভোলা---বেহিসাবি। কাকার ছিল প্রচন্ড ভ্রমণের নেশা। সারা পৃথিবীর মানচিত্র তিনি গুলে খেয়েছিলেন। সংসারে থাকার লোক তিনি ছিলেন না। অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি আর ভ্রমণের নেশা, এই দুইয়ের টানে কাকা ঘর ছাড়লেন। তাঁর আর কোন খোঁজ পাইনি। তিনিও আর কখনও যোগাযোগ করেননি। 
     ঠাকুরদাদা অনেক আগেই গত হয়েছিলেন, তখন ঠাকুমাও গত হয়েছেন। জ্যাঠা–কাকারা প্রত্যেকেই নিজেদের সংসার সামলাতে ব্যস্ত। কেউই কাকাকে খোঁজবার তেমন তাগিদ দেখালেন না। 
     কাকার জন্য আমার বড় মন খারাপ লাগত। কাকা একবার আমায় আফ্রিকার মাটাবেল-মাশাইদের দুর্ধর্ষ শিকার-কাহিনী শুনিয়ে বলেছিলেন তিনি আফ্রিকা চলে যাবেন। তারপর আমি বড় হলে আমাকেও সঙ্গে নেবেন। আমি ছোট কাকার সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরব। 
     কাকা কি তাহলে এখন আফ্রিকায় ? কে জানে...
    
     রবিবারের সকাল, দলবদ্ধ ভাবে কুরুক্ষেত্র, অর্থাৎ বাঁশতলায় উপস্থিত হলাম অস্ত্র-শস্ত্র সমেত।
     আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দুটি দল ভাগ হল---পান্ডব আর কৌরব। আমি পড়লাম পান্ডব পক্ষে। আমার চরিত্র হল ‘শ্রীকৃষ্ণ’। আমায় যুদ্ধ করতে হবে না, শুধু অর্জুনরূপী জ্যাঠতুতো দাদাটিকে কিছু উপদেশ ও পরামর্শ সরবরাহ করতে হবে। 
     যাইহোক, আমরা যে যার অবস্থান ঠিক করে নিলাম বাঁশ বাগানের দুই প্রান্তে। কেউ বাঁশঝাড়ের পিছনে, কেউ বা আপন ইচ্ছায় বেড়ে ওঠা কোন গুল্মের আড়ালে, কেউ আবার আগাছা ঝোঁপের পিছনে।
     প্রথমে দুই পক্ষের মধ্যে কিছুক্ষণ আক্রমণাত্মক সংলাপ বিনিময় চলল। যুদ্ধের পরিবেশ রচনায় এটাই নাকি নিয়ম।
     স্বর-বিনিময় শেষ হলে শুরু হল শর-বিনিময়। দু’পক্ষের সেনাপতিদের নির্দেশে শুরু হল যুদ্ধ। দু’পক্ষেরই বাঁশ গাছ, কলা গাছ, গাব গাছ, সুপারি গাছের গায়ে নিরন্তর তির আছড়ে পড়তে লাগল। 
     এরপর এক সময়, কাহিনী অনুসারে কৌরবপক্ষিয় রথি-মহারথিদের পতন শুরু হল এবং কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেল। 
     এখানে কর্ণ-চরিত্রধারী আমার প্রায় সমবয়সি খুড়তুতো ভাই প্রতীম কর্ণোচিত বিচক্ষণতা দেখাল। আমাদের বাড়িতে গোলাম মিঞা নামে এক ঠিকা শ্রমিক নিয়মিত কাজ করত। তার একটিমাত্র সম্পত্তি ছিল বড় জ্যাঠামশাইয়ের কিনে দেওয়া একখানা পুরনো, পাটাতন ভাঙ্গা তিন চাকার ভ্যান-রিক্সা। কাজ শেষে সে বাগান থেকে কাঠ, পাতা লতা ভ্যান বোঝাই করে বাড়ি ফিরত জ্বালানির জন্য। মাঝে মাঝে ভাড়াও খাটাত। ভ্যানটি সে সাধারণত বাঁশতলাতেই রেখে দিত। তাতে এটি সারাদিন ছায়া পেত আর নিরাপদেও থাকত।
     পূর্বপরিকল্পিত না হলেও কর্ণ তাৎক্ষণিক সেটিকেই তার রথ ভেবে নিল এবং তার পিছনের বাম দিকের চাকাটি ধরে ঠেলাঠেলি করতে লাগল মাটি থেকে তোলার জন্য। সঙ্গে বলতে লাগল, ‘আমার রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে, যতক্ষণ না তা আমি তুলতে পারছি ততক্ষণ যুদ্ধ বন্ধ রাখ।’
     আমি শ্রীকৃষ্ণ; অর্জুনের প্রধান উপদেষ্টা এবং তার রথের সারথি। নিতান্ত রথটা নেই বলে তা চালানোর দায়িত্ব নেই। তবে উপদেশ দেওয়াটা আমার কর্তব্য। তা না দিলে কর্তব্যে অবহেলা হয়। 
     তাই অর্জুনকে পরামর্শ দিলাম, ‘চালাও তির, এইই সুযোগ, তা না হলে তুমি কর্ণের সাথে সম্মুখসমরে পেরে উঠবে না।’
     অর্জুন সম্মত হল না। এ কাজ ক্ষাত্রধর্মবিরোধী---নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আক্রমণ কাপুরুষোচিত কর্ম। উপরন্তু ব্যক্তিটি আবার সম্পর্কে তার ভাই। সে ভ্রাতৃহন্তা হতে নারাজ। 
     তখন আমি উপদেশ দিলাম, ‘ওরে পাগল, তুমি যে নিমিত্তমাত্র, আসল কাজ তো আমিই করে রেখেছি। যাদের তুমি জীবিত ভাবছ তারা সকলেই আসলে মৃত। তুমি হত্যা করলেও এরা মৃত, না করলেও মৃত। আর তাছাড়া যাদের তুমি তোমার ভ্রাতা ভাবছ তারা আসলে তোমার শত্রু, তোমার প্রতিপক্ষ। সুতরাং কালব্যয় না করে শর নিক্ষেপ কর।’
     অবশেষে অর্জুন রাজি হল। কিন্তু তার হাতের নিশানা যে কিরূপ প্রাণঘাতী তা আমার ধারণা ছিল না। থাকলে আমি তাকে এ উপদেশ এবং পরামর্শ কখনই দিতাম না। 
     অর্জুনের বাণ কর্ণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গিয়ে বিঁধল তার রথের চাকায়। ওমনি গোলামের ছায়ায় এবং নিরাপদে থাকা ভ্যান-রিক্সার পিছনের বাম দিকের চাকাটি থেকে শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া নির্গত হতে লাগল। 
     এ দৃশ্য দেখে একযোগে পান্ডব এবং কৌরব সকল মহারথিরই বদন গোলামের ভ্যান-রিক্সার চাকাটির মতোই চুপসে গেল। 
     গোলাম ছিল বড় জ্যাঠামশাইয়ের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এবং সে ছিল অতি দরিদ্র। এই ভ্যান-রিক্সাটাই তার একমাত্র সম্বল। ফলে গোলামের এই সম্বলটির আক্রান্ত হওয়ার খবর জ্যাঠামশাইয়ের কানে পৌঁছালে আমাদের যে কি পরিণতি হবে, তা ভেবে সকলেই বিচলিত হয়ে উঠলাম।
     আমাদের মধ্যে সুধীনই ছিল বয়সে বড়, ফলে তার ঘটে বুদ্ধিও ছিল বেশি। সে আমাদের পরামর্শ দিল, ‘এখানে আর না, ঘাটে গিয়ে পড়া যাক, তারপর একটা কিছু ঠিক করা যাবে।’
     ঘাটে গিয়ে এ ঘটনার কথা আর কারওরই মনে রইল না। জলে হুড়োহুড়ি আর কাদা ছোড়াছুড়ি করতেই এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। ভেবে আর কিছুই ঠিক করা হল না। 
     বাড়ি ফিরে দেখি জ্যাঠামশাই বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে আর তাঁর পিছনে জেঠিমা। বারান্দার নিচে, উঠোনে দাঁড়িয়ে গোলাম কাতর মুখে কিছু অনুযোগ করছে। তার পাশেই ছোট কাকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বড় জ্যাঠামশাইয়ের ক্রোধান্বিত মুখভঙ্গি দেখে বুঝলাম আমাদের ভাগ্যাকাশে বিপদের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, তার পূর্বেকার দমকা হাওয়া বয়ে গেছে ছোট কাকার উপর দিয়ে।
     সন্ধের কিছু পরেই যথারীতি আসামিদের ডাক পড়ল। যে যার বই খাতা ফেলে রেখে এক ছুটে হাজির হলাম জ্যাঠামশাইয়ের এজলাসে। কে জানে, বিলম্বে যদি আবার শাস্তির আধিক্য ঘটে !
     জ্যাঠামশাই হাতে একটা লম্বা বেতের লাঠি নিয়ে ব্যস্ত ভাবে পায়চারি করছিলেন। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে ক্রুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘গোলামের ভ্যানের চাকায় কাটি ফুটিয়ে চাকা ফুটো করে দিয়েছে কে...সত্যি কথা বল।’
     ভয়তে আমার হৃদ্‌যন্ত্রটি সবেগে ধাবিত হতে লাগল, কান দুটি প্রচন্ড রকম গরম আর লাল হয়ে উঠেছে, চোখ দিয়ে জল প্রায় বেরিয়েই পড়েছিল। কিন্তু এত বিপর্যয়ের মধ্যেও, অন্যদের কথা জানি না, জ্যাঠামশাইয়ের প্রশ্ন শুনে মনে মনে আমার ভীষণ হাসি পেল। অর্জুনের মতো মহারথির লক্ষ্যভেদি বাণ কিনা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে হয়ে গেল ‘কাটি’...!
     কারও মুখে কোন উত্তর নেই, সকলেই নির্বাক্‌ হয়ে মাথা নিচু করে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। গরম কালের সন্ধে, গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি, মাঝারি মাপের ঘরটার দুই প্রান্তে দুটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে। এই হলদে-কোমল আলো-আঁধারির মায়াময় স্বপ্নালুতায় আমরা নির্বাক্‌-নতমস্তক-সারিবদ্ধ। আমাদের সম্মুখে জ্যাঠামশাই, তিনিও বাক্যহীন। মনে হল যেন চার্চে পাদ্রির সামনে দাঁড়িয়ে কোনো বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় মোমবাতির নরম আলোয় আমরা প্রার্থনা করছি।
     অনেকক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় কেমন একটা আচ্ছন্নতার ভাব হয়েছিল। তার মধ্যেই পুনরায় জ্যাঠামশাইয়ের হুঙ্কার কানে এল, ‘কি রে উত্তর দিচ্ছিস না যে, কথা কানে যাচ্ছে না ?’
     তবু কোনো উত্তর নেই...
     জ্যাঠামশাই যখন বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও উত্তরের কোনো আশা দেখলেন না তখন অবশেষে শাস্তি ঘোষণা করলেন, ‘সব ক’টা নিলডাউন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়। যতক্ষণ না মাথা ঘুরে পড়ছিস ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি। কেউ যদি উঠেছিস তো এই বেত ভাঙ্গব তার পিঠে।’
     এখানে বলে রাখি ‘নিলডাউন’ হল অত্যন্ত কর্কশ অথচ বহু কঠিন রোগের অব্যর্থ মহৌষধী। এর প্রক্রিয়া হল---হাত দুটিকে পিছন থেকে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে, মাজা ভেঙ্গে কান দুটি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে অন্তহীন মুক্তির অপেক্ষা। আবিষ্কর্তার নাম অজানা...
     এটাকে এক প্রকার মানহানিকর যোগব্যায়ামও বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগ অনুযায়ী ঔষধের কার্যকারিতা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘নিলডাউন’ অবস্থায় পিঠের উপর ইট বা ঐ জাতীয় ভারী পদার্থ চাপিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের অসুখ মনে হয় ততটা কঠিন ছিল না।
     কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম ঔষধ কাজ করছে এবং আমরা এতক্ষণ কার আত্মার শান্তি কামনা করছিলাম তাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। 
     মাথা ঘুরল না বটে, তবে অল্পক্ষণেই মনে হল ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। পা’দুটি ভীষণ ভাবে কাঁপতে লাগল। 
     কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন। কম্পমান দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখলাম বারান্দা দিয়ে ঠাকুমা এদিকেই আসছেন। পিছনে কিছু তফাতে জেঠিমা, তবে তিনি আসছেন না, একটু অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম তাঁর পক্ষে জ্যাঠামশাইয়ের মোকাবিলা করে আমাদের মুক্ত করা সম্ভব নয় বুঝেই ঠাকুমার শরণ নিয়েছেন।
     বড় জ্যাঠামশাই ছিলেন বাড়ির অভিভাবক। অত্যন্ত রাশ ভারি অথচ বিচক্ষণ মানুষ। বাবা-কাকারা সকলেই তাঁকে সমীহ করতেন, ভক্তিও করতেন। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর কারও কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। 
     বাড়ির সমস্ত কচি-কাঁচাদের আবদার সামলাতেন বড় জেঠিমা।
     কিন্তু জ্যাঠামশাই এত রাশভারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কোন দিন আমরা ঠাকুমার মুখের উপর কথা বলতে শুনিনি। বরং যে কোনো কাজ করতে হলে তিনি আগে যেতেন ঠাকুমার কাছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। 
     অতএব, ঠাকুমা আমাদের সার্বজনীন ত্রাতা। 
     ঠাকুমা এসে জ্যাঠামশাইয়ের শাসনের হানাবাড়িটিকে শূন্যে মিলিয়ে দিলেন, ‘কি রে বলাই, এই দুধের শিশুগুলোকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছিস কেন ?’
     ‘মা, এরা গোলামের কত বড় ক্ষতি করেছে তুমি জান না। বেচারা গরিব মানুষ, তার ভ্যানের চাকাটা ফাটিয়ে দিয়েছে ! ও এখন কি করে মেরামত করাবে ? দিন দিন এদের উপদ্রব বেড়েই চলেছে।’
     ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন, ‘তুই যেন ছেলেবেলায় খেলা করতে গিয়ে কোনো ক্ষয়ক্ষতি করিসনি, অ্যাঁ...! আমার আচারের শিশি ভেঙ্গে কি কান্ড করেছিলি বলব এদের ?’
     এ কথায় জ্যাঠামশাই অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। তিনি চাপা স্বরে বললেন, ‘মা, কি যে বল না বাচ্চাগুলোর সামনে ! আচ্ছা, ওর ভ্যানের মেরামতির খরচ আমি কাল দিয়ে দেব।’
     এরপর আমাদের মুক্তি আর আটকায় কে ? সেখানে আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে এক ছুটে যে যার ঘরে চলে গেলাম। শুধু আসার আগে জ্যাঠামশাই বললেন, ‘কাল থেকে যার হাতে ঐ লাঠি-কঞ্চি দেখব তার পিঠেই ভাঙ্গব, বুঝেছ ?’
     এরপর সত্যিই আর তির-ধনুক হাতে নেওয়া হয়নি। জ্যাঠামশাইয়ের ভয়তে লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু দিন খেলা হয়েছিল, কিন্তু সে খেলা আর তেমন জমত না।
     এর বছরখানেকের মধ্যে ঠাকুমা গত হলেন। মাস কয়েক পরেই ছোট কাকা ঘর ছাড়লেন। আমাদের গল্প শোনানোর আর তির-ধনুক তৈরি করে দেওয়ার আর কেউ রইল না। 
     আমরাও বড় হলাম। রামায়ণ-মহাভারতের সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়ল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আর টেলিভিশনের দৌলতে ঘনিষ্ঠতা হল ক্রিকেট-ফুটবলের সাথে। সোনালি দিনগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল... 
     আজ ঠাকুমা নেই, জ্যাঠামশাই নেই, জেঠিমা নেই, সুধীন দা চাকরীসূত্রে সপরিবার ভিনরাজ্যবাসী। ছোট ভাইগুলো কেউ বা কাজের তাগিদে, কেউ বা পড়াশুনোর খাতিরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বোনগুলির কয়েকটির বিয়ে হয়ে গেছে, কয়েকটির তোড়জোড় চলছে। আমি নিজেও জীবিকার তাড়নায় নগরবাসী হয়েছি। মাসে দু’এক দিন বাড়ি আসার সুযোগ পাই, কোনো মাসে তাও হয় না।
     অনেক চেষ্টা করেও আর আমরা এক জায়গায় হতে পারিনি। কারণ আমরা এখন ব্যস্ত, আমাদের সময় নেই। আমরা বড় হয়ে গেছি...অনেক বড়।

                                                               -----  ০০০  -----
     
     

No comments:

Post a Comment