Wednesday 18 October 2017

শিবাজী সেন

ব্যথা



     স্নাতকোত্তীর্ণ হওয়ার পর বেশিরভাগ মধ্য বা নিম্ন মেধার ছেলেদের যে
পরিণতি সাধারণত হয়ে থাকে আমারও তাই হল। অনন্ত চাকরির সন্ধান...
     এলাকায় এমনিতে ভালো ছেলে বলে সুনাম একটা ছিল। পড়াশুনোর ক্ষেত্রে
পরিবেশনা তেমন আশাপ্রদ না হলেও চট করে কেউ চারিত্রিক ত্রুটি ধরতে পারে
এমন কোনো কাজ জ্ঞানত কখনও করিনি। বাবা-মায়ের বাধ্য হয়ে চলেছি, ঠিক মতো
পড়তে গেছি, স্কুলে গেছি---আবার ঠিক সময়ে ফিরেও এসেছি। ঝুট-ঝামেলায়
পারতপক্ষে জড়াইনি।
     এই সময় আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট বেশ কিছু ছেলেকে স্কুলের মাঠে বসে
আড্ডা দিতে দেখতাম। দেদার অশালীনতার ফোয়ারা ছুটত সে আড্ডায়। সাথে
পাল্লা দিয়ে উড়ত ধোঁয়া। সন্ধের পর কাঁচের ঠুং ঠাং।
     এই দলটার মধ্যমণি ছিল পিন্টু নামে একটি ছেলে। আমি আসা-যাওয়ার পথে
বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি ছেলেটিকে। দেখতে শুনতে ভালোই, দেখেই বোঝা যায়
বেশ মার্জিত এবং অবস্থাপন্ন ঘরের কুসঙ্গে পড়ে বখে যাওয়া ছেলে।
     ছেলেটির অনেকগুলি তোষামুদে ছিল। সে যে এদের পিছনে বেশ মোটা অঙ্ক
ব্যয় করে, তা বলাই বাহুল্য। রাস্তায় গাড়ি ধরে জুলুম করে চাঁদা তোলা,
মেয়েদের কুমন্তব্য করা, যেখানে সেখানে যার তার সাথে ঝামেলা পাকানো,
মারপিট করা এসবই ছিল এদের সারা দিনের কাজ।
     আমি সর্ব প্রকারে এদের নৈকট্য এড়িয়ে চলতাম। অস্বীকার করব না, এদের
প্রতি, বিশেষত এই মধ্যমণিটির প্রতি আমার একটা ভীতিমিশ্রিত সমীহ ছিল। সাদা
বাংলায় এদের আমি ভয় করতাম। পুজো বা রক্তদান শিবিরের চাঁদা নিতে এলে
কোনো রকমে চাঁদাটা দিয়েই ঘরে ঢুকে পড়তাম।
     এলাকার প্রতিটি লোকের মুখে অহরাত্রি গালিবর্ষণ লেগেই থাকত। কেউই খুব
একটা ভালো চোখে এদের দেখত না।
     যাই হোক, কালের নিয়মে আমার মধ্যেও এক সময় হতাশা এল। বাড়ির সামনে
কিছুটা জায়গা ছিল। অবশেষে সেখানেই দোকান করে বসলাম, মুদিখানার দোকান।
     দোকানে পাড়ার মোটামুটি সবাই আসত। ব্যবসা খুব খারাপ চলছিল না। দিন
দিন খরিদ্দার বাড়ছিল। ভালোই লাগছিল।
     একদিন সন্ধেবেলা দোকানে আমি একা। দু’-একজন যারা ছিল তারাও একে একে
কাজ মিটিয়ে চলে গেল। আমি নিচু হয়ে মালপত্তর গোছগাছ করছি, এমন সময়ে
একটা পায়ের শব্দ পেয়ে উঁচু হলাম এবং যারপরনাই বিস্মিত হলাম। পিন্টু
দোকানে এসেছে।
     আমার কাছে সিগারেট চাইল, দিলাম---আগুন চাইল ধরানোর জন্য, দিলাম।
তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে নিজস্ব কায়দায় বলল, ‘খুব ভালো
হয়েছে আপনার দোকানটা হয়ে, মাঝে মাঝে আসব।’ এর উত্তরে আমি কি বলব কিছু
বুঝতে না পেরে কেবল হে হে করে হাসলাম। পিন্টু চলে গেল। আমিও হাঁফ
ছাড়লাম।
     এরপর থেকে সে প্রায়ই আসতে লাগল। বেশিরভাগ সময় সে সিগারেটই কিনত।
দু’-চারটে কথা বলে বিদায় নিত। তার অধিকাংশ কথাই ছিল গণ্ডগোল ও মারপিট
সংক্রান্ত এবং কাল রাতে কতটা নেশা করেছে আর আজ কতটা করবে সেই বিষয়ক। এসব
কথায় আমি কেবল হেসে আর ঘাড় নেড়ে সায় দিতাম। এসকল বিষয়ে বলার মতো
তেমন কিছুই আমার ছিল না।
     ধীরে ধীরে তার আসা-যাওয়া বাড়ল। তারই সাথে বাড়ল আমাদের
অন্তরঙ্গতাও। তার প্রতি আমার ভীতি অনেক কমে গিয়েছিল। পরিস্থিতিও সহজ হতে
লাগল। সে আমার তুলনায় বয়সে অনেক ছোট হলেও আমি তার সাথে বন্ধুর মতোই
মিশতাম।
     আমি বরাবরই বিশ্বাস করি যে, জগতে কোনো কিছুই যেমন সম্পূর্ণ ভালো হতে
পারে না তেমনই কোনো কিছুই সম্পূর্ণ খারাপও হয় না। প্রত্যেক খারাপের
মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা ভালো অবশ্যই থাকে। তাকে শুধু জাগাতে হয়;
খারাপটা আপনা থেকেই মরে যায়।
     আমার মতটা যে পুরোপুরি ভুল নয় তা উপলব্ধি করলাম। ছেলেটার সাথে যত
মিশতে লাগলাম ততই বুঝতে পারলাম তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। সে আড্ডায়
যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, সন্ধেটা আমার দোকানে বসেই কাটাচ্ছে। আড্ডা থেকে
ফোন এলে ধরছে না; মিথ্যে বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
     একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বন্ধুরা এতবার ফোন করছে, তবু তুমি
যাচ্ছ না, ব্যাপার কি?’
     সে বলল, ‘সত্যি বলছি দাদা, আমার এই সব বন্ধুবান্ধব, এই মারপিট,
ঝুটঝামেলা, এসব ভালো লাগে না। তার থেকে এখানে বসে আপনার সঙ্গে গল্প করে
অনেক শান্তি পাই।’
     আমি বললাম, ‘ভালো লাগে না যদি, তাহলে এসব কর কেন?’
     সে যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল, ‘কেন করি...?’ উদাস ভাবে কি যেন
খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘একদিন আপনাকে সব বলব। কোনোদিন
কাউকে বলিনি, আপনাকে বলব।’
     ইতিমধ্যে এই ছেলেটির অধিক আসা-যাওয়া, দোকানে বসে থাকা এবং মাঝে
মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে আমার সাথে দোকানের কাজে হাত লাগানো, আমার একাধিক
শুভাকাঙ্ক্ষীর চোখে লেগেছিল। তারা আমায় অনেক করে বোঝাতে লাগল যাতে আমি
ছেলেটির সঙ্গে মেলামেশা কমাই এবং তাকে দোকানে বেশি আসা-যাওয়া করতে বারণ
করে দিই।
     কিন্তু আমি বুঝেছিলাম ছেলেটি সত্যিই ততটা খারাপ নয় যতটা লোকে ভাবে।
তবু কেন যে সে এমন উচ্ছৃঙ্খলতা করে বেড়ায় মাথায় এল না।
      একদিন বেশ বেলা করেই পিন্টু দোকানে এল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি
ব্যাপার, আজ এত দেরি যে!’
     সে বলল, ‘কাল রাতে নেশাটা একটু বেশিই চড়ে গিয়েছিল। আজ সকালে ঘুম
ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। রান্না চড়াতেও দেরি হল।’
     আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘রান্না চড়াতে দেরি হল মানে? রান্না
কি তুমি কর নাকি!’
     সে মাথা নাড়ল।
     ‘কেন, তুমি রান্না কর কেন?’
     ‘কে করবে?’
     ‘তোমার মা...!’
     ‘আমার মা নেই।’
     মনে মনে বললাম, এই জন্যই তুমি এমন বখে গেছ, এবার বুঝলাম। মুখে কিছু
সহানুভূতি জানালাম বটে, কিন্তু সে কিছুই শুনছে বলে মনে হল না।
     মাঠের আড্ডায় পিন্টুর দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করতে একদিন
একটি ছেলে এল আমার কাছে। লম্বা, রোগা, ঢ্যাঙা মতো চেহারা। গাল তোবড়ানো।
এই বয়সেই স্বাস্থ্যের যে হাল করেছে তাতে বোঝাই যায় যে শরীরের উপর
যথেষ্ট অত্যাচার চলে।
     সে পান খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া দাঁত বার করে হাসল। দেখলাম সবে সন্ধে
হয়েছে, আর এরই মধ্যে লাল চোখ দুটি তার মদ্যপতার পরিচয় দিতে শুরু করে
দিয়েছে। চেহারা এবং বেশভূষা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে দু’বেলা আহার
জুটুক না জুটুক, বিহারটা ঠিক জুটে যায়।
     আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো তার বন্ধুর হঠাৎ সুবুদ্ধির উদয়ের জন্য
আমাকেই দায়ী করবে। হয়তো হুমকিসূচক কিছু বাক্য বিনিময় হবে। সেভাবেই
মনকে প্রস্তুত করছিলাম এবং পালটা ভাষা গোছাচ্ছিলাম। কিন্তু হল উলটো!
     চোখ রাঙানোর বদলে তার সৌজন্য দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সে
হাসি মুখে হাত জোড় করে বলল, ‘নমস্কার, আজ্ঞে, আমার নাম গোপাল। পিন্টু
এখন আপনার এখানেই সব সময় থাকে দেখি। খুব ভালো হয়েছে। ওকে মাঠের দিকে
যেতে দেবেন না। আপনার কথা ও শোনে। আপনি বললে ও আর যাবে না।’
     আমি বললাম, ‘তুমি চাওনা ও মাঠে যাক!’
     সে বলল, ‘পিন্টু আমার ছোটবেলার বন্ধু। জন্ম থেকে আমি ওকে চিনি। ভদ্র
ঘরের ছেলে। বাবা ভালো চাকরি করে। কত ভালো ছেলে ছিল জানেন? এক জনই ওর
জীবনটা ছারখার করে দিল। আমি তো খারাপ, অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছি।
কিন্তু পিন্টুও আমার মতো হোক এটা আমি চাই না, বিশ্বাস করুন...’
     বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল। যদিও গোপালের কথার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের
ভিতরটা মদের কটু গন্ধে ভরে উঠতে লাগল। তবু মনে হল সে কথাগুলো মন থেকেই
বলছে। তাছাড়া আমি শুনেছি, নেশা করলে নাকি মানুষ কথা বানিয়ে বলতে পারে
না। ফলে মনের কথা সহজেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
     এর কয়েকদিন বাদে পিন্টুর সমস্ত ঘটনাটা জানতে পারলাম। কিন্তু এভাবে
জানতে পারব তা ভাবিনি ---
     সেদিন সকালে পিন্টু দোকানের ভিতরে একটা টুলে বসে আছে। আমি খরিদ্দার
সামলাতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে কোন্‌ সময়ে গোপাল এসেছে। দোকান ফাঁকা হলে আমিও
তাদের সঙ্গে গল্পে যোগ দিলাম। এমন সময় একজন স্ত্রীলোক দোকানে এলেন।
লক্ষ্য করলাম দোকানে ঢুকেই পিন্টুকে দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন।
একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘কি রে পিন্টু, ভালো আছিস?’
     স্ত্রীলোকটিকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ল না। তবে পরণের দামি
শাড়ি, হালকা অলঙ্কার, গায়ের রং, কথা বলার কায়দা প্রভৃতি থেকে স্পষ্ট
যে ইনি সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ।
     কিন্তু এর পরেই একটা অদ্ভুৎ ঘটনা ঘটল। যে পিন্টু এতক্ষণ হাসি ঠাট্টা
করছিল স্ত্রীলোকটিকে দেখামাত্র তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল এবং একটা
বিদ্বেষভাব চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। স্ত্রীলোকটি কথাটা জিজ্ঞেস
করতেই সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে টুল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে লম্বা পা ফেলে এক
মুহূর্তে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।
     আমি তো অবাক! ব্যাপারটা কি ঘটল কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু
স্ত্রীলোকটির মধ্যে অস্বাভাবিকতার চিহ্নমাত্রও দেখলাম না। বরং তিনি এমন
ভাবে দু’ প্যাকেট বিস্কুট চাইলেন যে মনে হল যেন কিছুই হয়নি এবং যা ঘটল
তা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
     তিনি বিদায় নিলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হে গোপাল, ব্যাপারটা কি ঘটল?’
     এ ঘটনায় গোপালও খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হল না। বরং মনে হল সে
কিছুটা ভয় পেয়েছে। দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল তার চেহারায়। নিজের মনেই বলল,
‘আজ আবার...’
     আমি বললাম, ‘কেন, হলটা কি?’
     গোপাল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘তাহলে পুরো ঘটনাটা
আপনাকে বলি। পিন্টু কাউকে কোনোদিন বলেনি। আমি ওর ছোটবেলার বন্ধু, আমি সব
জানি।’
     তারপর সে বলতে শুরু করল---
     ‘পিন্টুর ঠাকুরদাদার আমল থেকে ওদের খুব বড় ব্যবসা, বিশাল অবস্থা।
পিন্টুর বাবারা দুই ভাই, বিপুল সম্পত্তির মালিক। ওর বাবাই ছোট। পিন্টুর
দাদু, অর্থাৎ মায়ের বাবা ছিলেন ওর ঠাকুরদাদার কর্মচারি। এলাকারই লোক,
নিতান্ত ছাপোশা। পিন্টুর জ্যাঠামশাই বরাবর পছন্দ করতেন পিন্টুর মা-কে,
বিবাহ করতে চাইতেন। কিন্তু পিন্টুর মায়ের পছন্দ ছিল ছোট ছেলে, অর্থাৎ
পিন্টুর বাবাকে। দুই ছেলের মধ্যে পিন্টুর বাবার রূপ এবং গুণ দুইই ছিল
অধিক। বুঝতেই পারছেন, উঠতি বয়স...তাছাড়া পিন্টুর মা-ও রূপে-গুণে ছিলেন
অসাধারণা। ফলে যা হয়---বাড়ি থেকে মেনে নেবে না বলে তাঁরা পালিয়ে বিবাহ
করলেন।
     খবর পাওয়ামাত্র পিন্টুর ঠাকুরদাদা উকিল ডেকে ঊইল বানালেন। তাতে ছোট
ছেলেকে ত্যাজ্য করে সমস্ত সম্পত্তি বড় ছেলের নামে করে দিলেন। নবদম্পতি
আশির্বাদ নিতে এলে তাদের বাড়িতে ঢুকতেও দেওয়া হল না। উপরন্তু এই ঘটনার
জেরে পিন্টুর দাদুর চাকরিটিও গেল। ছোট ছেলের কাজে ঠাকুরদাদার দম্ভে বড়
আঘাত লেগেছিল।
     এরপরেই ঠাকুরদাদা অত্যন্ত আসুস্থ হয়ে শয্যা নিলেন। ব্যবসা চলে গেল
বড় ছেলের হাতে। তিনি একাই তখন সমস্ত সাম্রাজ্যের অধিপতি। কিন্তু ছোট
ভাইয়ের স্ত্রীর প্রতি আসক্তি তাঁর তখনও যায়নি। পিন্টুর মাও সেকথা
জানতেন। পিন্টুর বাবা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, যোগ্য এবং অত্যন্ত ভদ্র। ফলে
একটা ভালো চাকরি পেতে এবং তাতে উন্নতি করতে তাঁর সময় লাগল না।
     এর মধ্যে পিন্টু আর পিন্টুর ভাই সন্টু দু’জনেরই জন্ম হয়েছে। সংসারে
কোনো অভাব নেই, কোনো অশান্তি নেই। বাড়ি থেকে দূরে একটি এলাকায় তাঁরা
ভাড়া থাকেন। এক কথায় যাকে বলে ভরা সংসার।
     কিন্তু পিন্টুর মায়ের তাতে মন ভরল না। তাঁর প্রত্যাশা ছিল অনেক
বেশী। তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া নিজের রূপ এবং গুণ নিয়ে একটা
স্বাভাবিক দেমাক তো ছিলই। আসলে তিনি গৃহিনী হতে চাননি, চেয়ছিলেন রাজরাণী
হতে।
     ইতিমধ্যে পিন্টুর জ্যাঠামশাই তাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে যাতায়াত
শুরু করলেন। দাদা খোঁজখবর নিচ্ছেন ভেবে পিন্টুর বাবা তাঁর প্রতি অত্যন্ত
কৃতজ্ঞ ছিলেন। পিন্টুও জ্যাঠামশাই বলতে অজ্ঞান। কিন্তু পিন্টুর মায়ের
সঙ্গে তাঁর ভাসুরের অন্তরঙ্গতা ক্রমে এমন স্তরে পৌঁছাল যে পিন্টুর বাবার
মনে একটা মৃদু সন্দেহের ছাপ পড়ল। দাদার পূর্বতন অভিলাশ সম্পর্কে তিনি
একেবারে অজ্ঞাত ছিলেন না।
     ঠাকুরদাদা দীর্ঘ রোগ ভোগের পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। এবং এই
সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা লাভ করলেন বড় ছেলে।
ব্যবসাও হল তাঁর একার।’
     এই পর্যন্ত বলে গোপাল থামল। দোকানে কিছু খরিদ্দার এসেছিল, তাদের কাজ
মিটিয়ে দেখি গোপাল বিড়ি ধরাচ্ছে। সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে গুছিয়ে
বসে সে আবার বলতে শুরু করল, ‘বাবার অন্ত্যেষ্টিতে উপস্থিত হয়েও ছোট ছেলে
কোনো ক্রিয়াকর্মে অংশ নিতে পারলেন না। মুখাগ্নী থেকে শ্রাদ্ধশান্তি বড়
ছেলে একাই করলেন।’
     এই ঘটনা থেকে পিন্টুর মায়ের কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে
গিয়েছিল যে, ভাসুর নিজে থেকে ভাইকে সম্পত্তির অংশীদার না করলে তাঁর
স্বামীর পক্ষে কখনই হৃত সম্পত্তি বা ব্যবসা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
অর্থাৎ যে বাসনা নিয়ে তিনি পিন্টুর বাবাকে বিবাহ করেছিলেন তা অধরাই থেকে
যাবে। এখন এই বাসনা চরিতার্থ করার উপায় একটাই---স্বামীকে ছেড়ে ভাসুরকে
বিবাহ করা। আর তা অসম্ভব নয়।
     শাশুড়ি গত হয়েছেন অনেক আগেই। বাধা দেওয়ার মতো ছিলেন এক
শ্বশুরমশাই, তিনিও নেই। সুতরাং রাস্তা সাফ। কিন্তু সবার আগে দরকার বিবাহ
বিচ্ছেদ। আর তা পাওয়ার জন্য চাই সংসারে অশান্তি।
     তাঁর ভাসুরের মতো মহানুভব মানুষ যে উব্‌জে সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার
ঔদার্য কখনোই দেখাবেন না সে বিষয়ে পিন্টুর মা নিশ্চিৎ ছিলেন। আর তাছাড়া
তিনি এও ভেবেছিলেন যে সম্পত্তির ভাগিদার হয়ে থাকার চেয়ে সমস্ত
সম্পত্তির একাই মালিক হওয়ার আনন্দ অনেক বেশি। সে সুযোগও যখন আছে, ছাড়ার
কোনো মানে হয় না।
     ফলে সংসারে আগুন লাগাবার যথাযত চেষ্টা তিনি চালিয়ে যেতে লাগলেন।
     কিন্তু পিন্টুর বাবা ছিলেন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় এবং ভদ্রলোক। তিনি
সর্বত ভাবে অশান্তি, গণ্ডগোল এড়িয়ে চলতেন। প্রয়জনে স্ত্রীর অনেক
অন্যায় দাবীও বিনা দ্বন্দ্বে মেনে নিতেন। ফলে পিন্টুর মায়ের কোনো
প্রয়াসই ঠিকঠাক জমল না।
     তিনি কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। বিচ্ছেদ পাওয়ার জন্য তিনি
তখন মরিয়া। পর পর বেশ কয়েক রাত বাইরে কাটিয়ে আসার পরও যখন তিনি দেখলেন
স্বামী কোনো প্রতিক্রিয়া করছেন না তখন অবশেষে তিনি এক চরম পদক্ষেপ
নিলেন। স্পষ্ট হুমকি দিলেন---স্বামী বিচ্ছেদ না দিলে দুই ছেলেকে তিনি বিষ
খাইয়ে মারবেন এবং নিজেও বিষ খাবেন। এর পর কোন্‌ স্বামী আর তাঁর স্ত্রীর
সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে চাইবে?
     সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এবং এই নিরন্তর অশান্তি থেকে মুক্তি
পেতে পিন্টুর বাবা স্ত্রীকে বিচ্ছেদ দিতে রাজি হন। তবু শেষ বারের জন্য
সন্তানদের মুখের দিকে একবার তাকাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু স্ত্রী তখন কোনো
কিছুই শোনবার, বোঝবার বা ভাববার অবস্থায় নেই। সম্পত্তির লোভ তখন তাঁকে
পেয়ে বসেছে। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই তিনি স্বামীকে বিচ্ছেদ দিয়ে
চলে গেলেন। সন্তানদের মুখের দিকে একবারও তাকালেন না।
     সরকারী কাজকর্ম মিটতে কয়েক মাস গেল। এরপরেই তিনি নিজের স্বামীর
একমাত্র দাদা, নিজের ভাসুরকে বিবাহ করলেন। তিনি হলেন সমস্ত সাম্রাজ্যের
সম্রাজ্ঞী। এত দিনের স্বপ্ন সার্থক হল। আর সেই একই সময় অন্য আর এক
জায়গায় তাঁর স্বামী দুই দুধের শিশুকে নিয়ে পড়লেন এক অসহায় অবস্থার
মধ্যে। পিন্টু তখন ছ’ বছর, সন্টু চার।’
     গোপাল আবার থামল। বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিল।
     আমি একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘সত্যিই...দুঃখজনক।’
     গোপাল ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেসে বলল, ‘এখনই দুঃখ
জানাবেন না দাদা, এখনও কিছুটা আছে।
     ---পিন্টুদের বাড়িওয়ালা ছিলেন এক বৃদ্ধ এবং এক বৃদ্ধা। পিন্টুদের
উপরের তলায় থাকতেন তাঁরা। এঁরা ছিলেন বড় একা। মেয়ে-জামাই কর্মসূত্রে
অন্যত্র থাকত। বছরে একবার বাড়ি আসত, পূজোর সময়। বাকি সময়টা তাদের কাটত
একাকিত্বে।
     পিন্টুদের দুই ভাইয়ের দায়িত্ব তাঁরাই নিলেন। এই দুটিকে পেয়ে
তাঁরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের সারা দিনের কাজ ছিল দুই ভাইয়ের
যারপরনাই পরিচর্যা করা, পিন্টুর বাবাকে দু’বেলা রান্না করে দেওয়া আর
অবসর সময়টা পিন্টুর মাকে মনের আশ মিটিয়ে শাপ-শাপান্ত করা।
     ক্রমে পিন্টু প্রাকৃতিক ও জৈবিক নিয়মে বড় হল। স্কুল শেষ করে কলেজে
গেল। কলেজে রাণী নামে একটি মেয়েকে পিন্টুর ভালো লেগে গিয়েছিল। ভালো
লাগা থেকে ভালোবাসা, তা গভীরতর হয়ে ঘনষ্ঠতা।
     মেয়েটি দেখতে শুনতে যাকে বলে অতুলনীয়া। আচার ব্যবহারও তদ্রূপ।
নম্র, ভদ্র, শান্ত...এক কথায় এমন মেয়ে যার জীবনসঙ্গিনী হবে সে
ভাগ্যবান।
     দুই পক্ষ থেকেই সম্মতি ছিল। পিন্টুর বাবা এমন পুত্রবধূ পাবেন ভেবে
মনে মনে নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। সংসারটা এবার হয়তো স্থিরতা পাবে!
     এই পর্যন্ত সব ঠিক ঠাক ছিল। পিন্টুর জীবনও চলছিল আর পাঁচটা ছেলের
মতো সোজা পথে, নিস্তরঙ্গ ভাবে। বিশ্বাস করুন পিন্টু ছিল একেবারে সোজা
পথের পথিক। মারপিট, ঝুট ঝামেলার ধারে কাছে কখনও যেত না। আর নেশা...? হাঃ
হাঃ, জীবনে এক কাপ চা-ও বোধহয় কখনও ছোঁয়নি।
     কিন্তু একটা সকালের মধ্যে ওর জীবনটা সম্পূর্ণ ওলট পালট হয়ে গেল---
     বেশ কয়েক বছর ধরেই পিন্টুদের বাড়িওয়ালা বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দু’জনেই
ছিলেন শয্যাসায়ী। পিন্টুরা তাঁদের নিজের বাবা-মায়ের মতো সেবা করে।
অবশেষে বছর দুই আগে প্রথমে বৃদ্ধ এবং তার কয়েক মাস পর বৃদ্ধা মারা যান।
     সেই থেকে পিন্টুই রান্না-বান্না করে। বাবা যেদিন বাড়িতে থাকেন
সেদিন তিনিই করেন। ইতিমধ্যে ওরা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পাশেই জমি কিনে বাড়ি
করেছে। আগের বাড়িটা এখন ফাঁকাই পড়ে আছে। পিন্টুরাই দেখা শোনা করে। মাঝে
মাঝে মেয়ে-জামাই এসে থাকে।
     যাই হোক, যা বলছিলাম---সেদিন পিন্টু কলেজে গিয়েছিল। ওর বাবা
বাড়িতেই ছিলেন। কলেজে গিয়ে পিন্টু দেখল রাণী আসেনি। পিন্টুর মন খারাপ
হয়ে গেল, ক্লাসে মন বসল না। দু’একটা ক্লাস করে সে বাড়ি ফিরে এল।
     এসে দেখল বাবা চুপ করে বসে আছেন। পিন্টুকে দেখে তিনি বললেন---রাণীর
বাবা এসেছিলেন। তিনি কোনোভাবে তোমার মায়ের ইতিহাস জেনেছেন। এরকম পরিবারে
তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়েছেন। অতএব তুমি রাণীর
সঙ্গে আর কোনো রকম সম্পর্ক রাখবে না। আরও ভালো মেয়ে দেখে তোমার বিয়ে
দেব।
     পিন্টু তখন রাণীর জন্য পাগল। প্রেমিকের মন এই শুকনো নিষেধাজ্ঞা
মানবে কেন? তখনই সে ছুটল রাণীর বাড়ি তার বাবাকে বোঝাতে। আগে থেকেই এ
বাড়িতে তার আসা যাওয়া ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে এক কাণ্ড! স্বয়ং
পিন্টুর জ্যাঠামশাই রাণীর বাবার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। সে বুঝল এদের আগে
থেকেই যোগাযোগ ছিল। পিন্টুর তখন ধারণা হয়েছিল, যদিও জানি না এ ধারণা ঠিক
কিনা, সম্বন্ধ ভেঙ্গে দেওয়াটা ছিল জ্যাঠামশাইয়েরই কারসাজি।
     পিন্টুর মাথায় আগুণ জ্বলে ওঠে। সে দিগ্‌বিদিক্‌, স্থান-কাল সমস্ত
জ্ঞান রোহিৎ হয়ে জ্যাঠামশাইকে আক্রমন করতে উদ্যত হল। যদিও চাকর-বাকররা
তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে ফেলে এবং জ্যাঠামশাই বেঁচে যান।
     সে তখন পুরোপুরি উন্মাদ্‌। হাত-পা ছুড়ছে, অশ্রাব্য গালি গালাজ
করছে। রাণীর বাবা তখনই থানায় ফোন করলেন। তিনি প্রভাবশালী লোক। পুলিশ
আসতেও দেরি হল না।
     এরপর কিছুটা রাণীর বাবার প্রভাবে, কিছুটা জ্যাঠামশাইয়ের প্রভাবে
পিন্টুর ওপর কিছু জামিনযোগ্য, কিছু জামিন অযোগ্য ধারা আরোপ হল। ফলে আগামী
কয়েক মাস তার ঠিকানা হল হাজত।
     হাজতে ওর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিসহ। রোজ আদালতে হাজিরা, কাঠগড়ায়
ওঠা, ঘন্টার পর ঘন্টা এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার সন্ধের পর নোংরা,
অন্ধকার, ঘুপচি ঘরটায় এসে ঢোকা। আদালতে লোকের তির্যক দৃষ্টি তো ছিলই,
উপরি পাওনা ছিল প্রায় সারা রাত পুলিশের অকথ্য অত্যাচার। ঘুম না, খাওয়া
না, স্নান না --- শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। তাছাড়া জেলের ভিতর খাটুনিও
ছিল।
     পিন্টুর বাবা প্রায় সাত-আট মাস ধরে নানান জায়গায় ঘুরে, বিভিন্ন
ছোট বড় উকিলের সাথে পরামর্শ করে, বহু অর্থব্যয়ে অবশেষে তার জামিনের
ব্যবস্থা করেন।
     জেল থেকে সে যখন বেরল তখন তাকে দেখে কে বলবে যে এ সেই পিন্টু !
চেহারার আমূল পরিবর্তণ ঘটে গিয়েছে। আগের চেহারার সঙ্গে তার কোনো মিলই
নেই। শীর্ণ, কালো, দুর্বল চেহারা---চোখে মুখে শঙ্কা আর লজ্জার ছাপ। তার
পাওনা তখন লোকের গঞ্জনা, অপবাদ, কটুক্তি, ফিস্‌ফাস্‌।
     কিন্তু তখন কে জানত যে চেহারার সাথে সাথে চরিত্রও আমূল পালটে যাবে ছেলেটার!
     পালটে গেল, যখন দুটো খবর ওর কাছে পৌঁছালো। দুটো খবর ওকে একেবারে
মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। প্রথম, কলেজ থেকে ওর নাম কাটা গেছে। ওকে
নিঃশর্তভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানেই
স্থান পাবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে দাগি আসামির জায়গা নেই। ফলে উচ্চশিক্ষার
এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার।
     আর দ্বিতীয়, যাকে ও পাগলের মতো ভালোবাসত, যে ছিল ওর প্রাণের চেয়েও
প্রিয়, যার জন্য আজ ওর এই পরিণতি সেই রাণীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। সে
সুপাত্র লাভ করেছে। এবং এই বিয়েতে তার সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল।
     এত আঘাতের পর যে কোনো মানুষের সামনে একটা রাস্তাই খোলা
থাকে---আত্মহত্যা। ও কিন্তু সে রাস্তায় একেবারেই হাঁটেনি, একবারের জন্যও
আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। মনের দিক থেকে এতটাই শক্ত ছিল ও। বরং নিজেকেই
পালটে ফেলল সম্পূর্ণ ভাবে।
     সেদিনই প্রথম ও আমার সঙ্গে আমাদের আড্ডায় যেতে চাইল, জানেন! আমি
প্রথমটা খুব অবাক হলাম। তারপর ভাবলাম ও হয়তো কিছুটা সময় কাটাতে চায়,
হয়তো একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা কাটাতে চায়। সাদা মনেই ওকে নিয়ে গেলাম। আমার
বন্ধুরা কেউ ভালো নয় তা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি। তবু ওদের সাথে
আলাপ করিয়ে দিলাম। আর কি বলব দাদা, ও সে দিনই এত মদ খেল যে ওকে ভ্যানে
শুইয়ে বাড়ি দিয়ে আসতে হল। আমার কোনো কথা, কোনো নিষেধই শুনল না।
     তার চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার কি জানেন, সেদিন সমস্ত খরচ ওইই করল এবং
তারপর থেকে ক্রমাগত করে আসছে। আমার কোনো কথাই ও শোনে না। রাতারাতি ওর এই
অধঃপতন দেখে নিজের চোখকেই আমি বিশ্বাস করতে পারি না।’
     গোপাল কথাগুলো বলতে বলতে দু’হাতে মুখ ঢাকল। বুঝলাম সত্যিই ওর বন্ধুর
জন্য কষ্ট হচ্ছে। শেষ দিকে ওর গলাটাও যেন একটু কেঁপে গেল।
     কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। ঘটনার মধ্যে আমরা এতটাই ডুবে গেছি যে বেলা
কত হল সেদিকেও খেয়াল নেই। অন্য দিন সাধারণত এই সময় দোকান বন্ধ করে দিই।
আজ সে কথা মনেও এল না।
     আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, ও যে এত টাকা রোজ ওড়ায়, এ টাকা ও পায়
কোথায়? বাবার কাছ থেকে না নিশ্চয়ই!’
     গোপাল বলল, ‘এমনিতে ওর বাবা এখন ভালো পদেই চাকরি করেন। কিন্তু ছেলের
অবস্থা সম্পর্কে তিনি একেবারে অনবহিত নন। কারণ একসময় যে ছেলের ভালো বলে
সারা এলাকায় সুনাম ছিল এখন লোকে তাকে এক ডাকে চেনে তার কুখ্যাতির জন্য।
ফলে তিনি ছেলের হাতে টাকা কোনো মতেই দেবেন না।’
     ‘তাহলে!’
     ‘তারও একটা উপায় হয়ে গেল। আর মজার ব্যাপার, সেখানেও জ্যাঠামশাইয়ের হাত।’
     ‘কি রকম?’
     ‘বলতে পারেন ঈশ্বরের পরিহাস! জ্যাঠামশাই এবং জেঠিমা, অর্থাৎ পিন্টুর
মায়ের নতুন দাম্পত্য জীবনের পরিণতি লাভ হল না। মানে তাঁদের সন্তান ভাগ্য
খারাপ।
     সন্তানাদি না হওয়ায় পিন্টুর প্রতি তার মায়ের নতুন করে মাতৃত্ব
জেগে ওঠে। ফলে তার নিদর্শণ স্বরূপ তিনি পিন্টুর হাতখরচ বাবদ বেশ একটা
মোটা অঙ্ক ধার্য করেন। এই টাকা ডাক পিওনের মাধ্যমে পিন্টুর হাতে পৌঁছয়।
পিন্টু ছাড়া অন্য কেউ সই করে এ টাকা তুলতে পারবে না, ব্যবস্থা এ রকমই।
     তাহলেই বুঝতে পারছেন তো এসব স্নেহ-টেহ সব ভাঁওতা। আসল উদ্দেশ্যই হল
ছেলেটার চরম সর্বনাশ। যে আত্মহত্যা করতে চাইছে তার হাতে বিষের শিশি তুলে
দেওয়াকে কি স্নেহ বলা যায় বলুন তো!’
     আমি চুপ করে সমস্ত ঘটনাটার একটা দৃশ্যায়ন করবার চেষ্টা করছিলাম মনে
মনে। দৃশ্যগুলো পর পর সাজাতে সাজাতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
হঠাৎ গোপালের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম সে তার কোটরাভ্যন্তরস্থ চোখ দুটি
আমার মুখের দিকে স্থির রেখে উত্তরের অপেক্ষায় আছে।
     আমি ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলাম, ‘ওর বাবা কিছু বলেন না?’
     গোপাল একটা একপেশে হাসি হাসল। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। কিন্তু
তাচ্ছিল্যের থেকে তাতে বিরক্তিই বেশি প্রকাশ পেল, ‘ওর বাবার কথা আর বলবেন
না। সব ক্ষেত্রে যে বেশি ভালো মানুষ হলে চলে না এটা ওর বাবা কোনোদিনই
বোঝেননি। ছেলের হাতে পয়সার অভাব যখন নেই তখন ছেলেকে আটকানো তাঁর পক্ষে
সম্ভব নয়।’
     আমার আর কিছুই বলার ছিল না। চুপ করে রইলাম। লক্ষ্য করলাম শেষ
দিকটায় গোপালের কন্ঠস্বর আবেগরুদ্ধ হয়ে এল। দুই হাত দিয়ে সে মুখ ঢেকে
ফেলল।
     ‘ওকে কি আর ফিরিয়ে আনা যায় না?’---মনে হল এটা কথা নয়, আকুতি এবং
তা কন্ঠ দিয়ে নয়, বার হল অন্তর থেকে।
     সেটা সম্ভব কিনা বা কি ভাবে সম্ভব তা আমার জানা নেই। তাই এ কথার
কোনো উত্তর দিলাম না। তার বদলে, একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে
ঘুরছিল, সেটাই করলাম, ‘তাহলে এই মহিলাই কি...’
     গোপাল ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, ‘ইনিই পিন্টুর মা। এঁর বাবা এখনও
জীবিত, এখানেই থাকেন। তাঁকে দেখতেই মাঝে মাঝে আসেন।’

No comments:

Post a Comment